জুবাইয়া বিন্তে কবির
“সম্পর্ক”—শব্দটার মাঝেই আছে এক অদৃশ্য টান, এক উষ্ণ আলো। সম্পর্কের ভেতর লুকিয়ে থাকে বিশ্বাস, মায়া, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব, আর একরাশ অদেখা ভালোবাসা। এই সম্পর্ক যদি হয় কর্মক্ষেত্রে, তবে তাতে যোগ হয় দায়িত্ববোধের এক বাড়তি মাত্রা। সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিনের কথাবার্তা, হাসি, অভিমান—সব মিলিয়ে কর্মস্থল হয়ে ওঠে এক চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজকাল আমরা যেন একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। অফিসের পাশের সিটে বসা মানুষটিকে বলার বদলে আমরা ইমেইল পাঠাই; সামনাসামনি অনুরোধ না করে ‘অফিসিয়াল টোনে’ মেসেজ লিখে ফেলি। আমরা কাজ করি, কথা বলি, হাসি—কিন্তু সম্পর্কের ভেতর সেই উষ্ণতা, সেই আন্তরিকতা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এ কারণেই আমাদের কর্মজীবনের নীরব শূন্যতা দিনদিন বাড়ছে।
এক নিঃশব্দ গল্পের শিক্ষা : একবার পড়েছিলাম এক বিদেশি গল্প। এক সিইও, যার সাথে তার ড্রাইভারের কথোপকথন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল কয়েকটি শব্দে—“চলো”, “থামাও”, “অফিস”, “বাসায় যাও” ইত্যাদি। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সিইও একটি শপিংমলের পাশে গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকে যান। কয়েক মিনিট পর এক ঝোড়ো হাওয়ায় গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার ভেবেছিলেন, স্যার ফিরে এসে দরজা বন্ধ করেছেন। তিনি গাড়ি চালাতে শুরু করেন। প্রায় বিশ কিলোমিটার দূর যাওয়ার পর ফোন আসে—ওপাশে সিইও! গল্পটা ছোট, কিন্তু শিক্ষাটা গভীর। আমরা কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় এমনই হয়ে যাই। পাশের মানুষটা ঠিক আছে কি না, সে কথা ভেবে দেখি না। শুধু নির্দেশ দিই—“এই কাজটা করো”, “ফাইলটা দাও”—তাতেই দায়িত্ব শেষ। অথচ, সম্পর্কের ভিত মজবুত না হলে কাজের সাফল্যও স্থায়ী হয় না।
সিনিয়র-জুনিয়র: সম্পর্ক না দূরত্ব? আমাদের সমাজে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে—“সিনিয়র মানেই দূরে থাকা”! আমরা ভাবি, দূরত্ব বজায় না রাখলে ‘সম্মান’ নষ্ট হবে। অথচ, বাস্তবটা ঠিক উল্টো। একজন সিনিয়র যতটা কাছাকাছি আসেন, ততটাই জুনিয়রের মনে আস্থা জন্মায়। সেই আস্থাই পরে হয়ে ওঠে দক্ষতা, নিবেদন ও দায়িত্ববোধের প্রেরণা। সিনিয়রের দায়িত্ব কেবল কাজ ভাগ করে দেওয়া নয়—বরং সেই কাজের লক্ষ্য, মিশন আর গুরুত্বটি বোঝানো। কারণ, জুনিয়রের চোখে যে কাজ “সাধারণ”, সিনিয়রের দৃষ্টিতে তা হতে পারে “কৌশলগত”। তাই যোগাযোগের অভাবই জন্ম দেয় ভুল বোঝাবুঝির। অন্যদিকে, জুনিয়রেরও বোঝা উচিত—অভিজ্ঞতা কোনোদিন বয়স দিয়ে মাপা যায় না, সেটি আসে সময় ও আত্মনিবেদনের মাধ্যমে।
সম্পর্ক মানে অভ্যর্থনা : যখন একজন নতুন কর্মী, নতুন ছাত্র বা নতুন সহকর্মী কোনো প্রতিষ্ঠানে আসে, তার মনে থাকে একরাশ ভয় ও অনিশ্চয়তা। সে জানে না কার কাছে যাবে, কাকে জিজ্ঞাসা করবে, কেমন আচরণ পাবে। ঠিক তখনই যদি সিনিয়র সহকর্মীর একটি হাসিমুখে “স্বাগত” মেলে—তবে সেটিই হয়ে ওঠে তার আত্মবিশ্বাসের প্রথম ভিত্তি। একটি বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি, একটি “আমি আছি পাশে”—এই কয়েকটি শব্দই পারে কর্মস্থলের পরিবেশকে বদলে দিতে।
অভিজ্ঞতার আলোর ভাগ : সিনিয়রদের কাছে থাকে অমূল্য অভিজ্ঞতা—যা বইয়ে লেখা নেই, জীবনে শেখা। কোন কাজ কীভাবে করতে হয়, কার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কোন ভুলগুলো একেবারেই না করা উচিত—এই বাস্তব শিক্ষা জুনিয়রের কাছে এক অনন্য সম্পদ। যদি সিনিয়ররা আন্তরিকভাবে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন, তবে জুনিয়ররা ভুল পথে না গিয়ে দ্রুত সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে সিনিয়রের নেতৃত্বগুণও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একজন ভালো সিনিয়র কেবল নিজের সাফল্যে নয়, নিজের অধস্তনদের সাফল্যে গর্ব অনুভব করেন। কারণ, নেতৃত্বের প্রকৃত মাহাত্ম্য এখানেই।
সহমর্মিতার সংস্কৃতি : শিক্ষাঙ্গন হোক বা অফিস—সব জায়গাতেই সহমর্মিতা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যেখানে সিনিয়ররা জুনিয়রের ভুল দেখে উপহাস না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, যেখানে সমালোচনার বদলে পরামর্শ দেওয়া হয়, সেখানে সম্পর্ক টিকে থাকে, আস্থা বাড়ে, আর কাজের মান বেড়ে যায়। অনেক সময় ভুল হয়—জুনিয়রও করে, সিনিয়রও করে। কিন্তু ভুলের পুনরাবৃত্তি না হওয়াটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। দোষ নয়, সমাধান খুঁজে বের করাটাই হবে দায়িত্ববোধের প্রকাশ।
যখন প্রজন্ম বদলায় : বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর আমরা হঠাৎ এক নতুন বাস্তবতায় পড়ি। সেখানে সবাই আর সমবয়সী নয়। কেউ হয়তো বয়সে অনেক বড়, কেউ আবার একেবারে নবীন। এই ভিন্ন বয়স, ভিন্ন প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে কাজ করাই আসলে জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
মোহসিনা মিঞ্জু (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। বলছিলেন—“সহকর্মীরা যখন কথা বলতেন, তাদের অনেক কথাই আমার মাথার ওপর দিয়ে যেত। বয়সে তারা বড় ছিলেন, পরিবার, সন্তান, আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতেন। আমি চুপ করে নিজের কাজ করতাম।”এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি নতুন কর্মীদের মধ্যে খুব সাধারণ। দল যখন বহু বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করে, সেখানে নতুন কেউ এলে প্রথমে তাকে ‘অপর’ মনে হয়। কিন্তু ধৈর্য ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে এই ব্যবধান কমাতে। দিকনির্দেশনার শূন্যতা : এলজিইডির সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মুহাইমিনুল আলম ফাইয়াজ বলেছিলেন, “ম্যানেজারের সঙ্গে আমার বিচ্ছিন্নতা ছিল ভয়াবহ। আমাকে কাজের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে কাজ যত না কঠিন ছিল, তার চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।”এই কথার ভেতর লুকিয়ে আছে হাজারো কর্মীর বাস্তবতা। একজন সিনিয়র যদি নিজের জুনিয়রকে সঠিকভাবে ‘ব্রিফ’ না করেন, তাহলে সে কখনোই নিজের জায়গা বুঝে উঠতে পারে না।
ফলে কর্মক্ষেত্রে তৈরি হয় বিভ্রান্তি, হতাশা আর একাকীত্ব।
সিনিয়রের উষ্ণতা, জুনিয়রের শ্রদ্ধা : হুয়াওয়ের সলিউশন আর্কিটেক্ট মুবাল্লিগ হোসেন বলেন, “নতুন চাকরিতে প্রথমেই অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শেখা উচিত।”তার মতে, “মন খোলা রাখলে বোঝা যায়—কত কিছু শেখার আছে!”একই কথা বলেছেন বিপণন পেশাজীবী আশরাফুল, “আগে ভাবতাম বয়স্ক সহকর্মীরা অনমনীয়। পরে দেখেছি, সম্মান দিলে তারাও মন খুলে দেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা মানেই যোগাযোগের সেতু।”জেনারেশন গ্যাপের দেয়াল ভাঙার শুরুটা এখানেই—শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার জায়গা থেকে।
সম্পর্কের সেতুবন্ধন : একই অফিসে নানা বয়সী মানুষ। কেউ টিকটকের কথা জানেন না, কেউ মেমের রাজা। কেউ চা না খেলে সকাল শুরু হয় না, কেউ কফি ছাড়া ভাবতেই পারেন না।
কিন্তু এই বৈচিত্র্যই কর্মক্ষেত্রের সৌন্দর্য।
জাপান বাংলাদেশ কানেক্ট লিমিটেডের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শাফিন মাহমুদ বলেন, “আমরা ফুটবল আর খাবারের মাধ্যমে দারুণ সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলাম। ছোট ছোট মিলগুলো খুঁজে পেলেই দূরত্ব গলে যায়।”
একই আগ্রহ, একই আনন্দ—এই সাধারণ সূত্রগুলোই সম্পর্ককে গভীর করে তোলে।
শিক্ষার নামে অসৌজন্য নয় : দুঃখজনকভাবে কিছু জায়গায় সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের নামে দেখা যায় আধিপত্য, র্যাগিং, অপমান—যা কোনো সভ্য সমাজের সঙ্গে মানায় না। শিক্ষাঙ্গন বা অফিস—যেখানে জ্ঞান ও মানবিকতা বিকশিত হওয়ার কথা, সেখানে অবমাননা মানে নিজের সংস্কৃতির অবক্ষয়। জুনিয়রদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন মানে শুধু সৌজন্য নয়—এটি আমাদের নৈতিকতার প্রতিচ্ছবি। পরিবারে ছোট ভাইবোনদের যেমন যত্ন করি, কর্মক্ষেত্রেও তেমন আচরণ করা উচিত।
স্নেহের উত্তরাধিকার : একজন জুনিয়র যখন সিনিয়রের কাছ থেকে ভালোবাসা, সহযোগিতা ও শ্রদ্ধা পায়—তখন সে ভবিষ্যতে তার জুনিয়রের প্রতিও একই আচরণ করে। এভাবেই সম্পর্কের সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। সিনিয়র যদি বলেন, “তুমি পারবে”—তাহলেই হয়তো জুনিয়রের ভেতর জন্ম নেয় এক অদম্য আত্মবিশ্বাস। এটাই সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শক্তি।
মানবিক কর্মসংস্কৃতির স্বপ্ন : একটি প্রতিষ্ঠান কেবল ভবন বা পদবির সমষ্টি নয়; এটি মানুষের সমষ্টি। যেখানে মানুষ মানুষকে সম্মান করে, সাহায্য করে, ভুলে একসাথে শেখে—সেখানেই প্রকৃত কর্মসংস্কৃতি বিকশিত হয়।জালাল উদ্দিন একবার বলেছিলেন, “বয়সের পার্থক্য থাকলেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা রাখলে কর্মস্থল সহযোগিতামূলক হয়ে ওঠে।”
তার এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবিক কর্মজীবনের সারাংশ।
সহমর্মিতার সংস্কৃতি : শিক্ষার পাশে সাহসের পাঠ
শিক্ষাঙ্গন হোক বা অফিস—সব জায়গাতেই সহমর্মিতা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যেখানে সিনিয়ররা জুনিয়রের ভুল দেখে উপহাস না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, যেখানে সমালোচনার বদলে পরামর্শ দেওয়া হয়, সেখানে সম্পর্ক টিকে থাকে, আস্থা বাড়ে, আর কাজের মান বেড়ে যায়। অনেক সময় ভুল হয়—জুনিয়রও করে, সিনিয়রও করে। কিন্তু ভুলের পুনরাবৃত্তি না হওয়াটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। দোষ নয়, সমাধান খুঁজে বের করাটাই হবে দায়িত্ববোধের প্রকাশ।
তবে কর্মজীবনের বাস্তবতা সব সময় এত সহজ নয়। আপনি যত সৎ, যত যোগ্য, যত নিষ্ঠাবান হবেন—ততই আপনার চারপাশে শত্রুর সংখ্যা বাড়বে। অসৎ, অযোগ্য আর দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ আপনার সততা সহ্য করতে পারে না। তাদের চোখে আপনি এক প্রকার আয়না—যেখানে তাদের অসৎ মুখটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই তারা আপনাকে কর্মস্থলে মানসিকভাবে, কখনো কখনো শারীরিকভাবেও হেনস্তা করার চেষ্টা করবে। তারা সিনিয়র-জুনিয়র ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামবে।
কিন্তু মনে রাখবেন, সততার শত্রুরা যত সংখ্যায় বেশি হোক, তাদের ভয়ও তত গভীর। কারণ, মিথ্যার অন্ধকার কখনো আলোর সামনে টিকে না। আপনি যদি নীতিতে অটল থাকেন, যদি কর্মে নিষ্ঠাবান থাকেন, তবে তারা যত চেষ্টাই করুক, আপনাকে ভাঙতে পারবে না।
একদিন সেই অসৎ মানুষগুলোই নীরবে আপনার শক্তির সামনে মাথা নত করবে। তাই ভয় পাবেন না, ভেঙে পড়বেন না। আল্লাহর উপর দৃঢ় ভরসা রাখুন। যিনি দেখেন, জানেন, আর ন্যায়ের প্রতিটি বিন্দুকে মূল্যায়ন করেন—তিনি আপনার সহায়ক হবেন। কারণ, সততার পথ যত কণ্টকাকীর্ণই হোক, সেটিই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় সম্মানের শিখরে।
পরিশেষে, সন্মান দিন, সন্মান পান : জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকে সম্পর্কের জ্যোৎস্না। একটি আন্তরিক অভিবাদন, একটি উৎসাহমূলক বাক্য—কখনো কখনো পুরো কর্মজীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে। তাই বলব, কর্মস্থলে উন্নতির পেছনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিকল্প নেই। অন্যকে সম্মান করুন, তাহলেই নিজেও সম্মানিত হবেন। সিনিয়রদের স্নেহ আর জুনিয়রদের শ্রদ্ধা মিলেই গড়ে উঠুক এমন এক কর্মপরিবেশ—
যেখানে সম্পর্কের শূন্যতা নয়, বরং উষ্ণতার আলোয় সবাই আলোকিত হয়।