বিকল্প লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে পুঁজিবাজারে অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) চালু করা হয়। লক্ষ্য ছিল– তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোর জন্য একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটিকে গড়ে তোলা। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ঝামেলামুক্ত ও খরচ বাঁচানোর মাধ্যম হিসেবে এটিবি চালু হয়। এই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াও অনেকটা সরাসরি বা ডিরেক্ট লিস্টিংয়ের মতো সহজ। তা সত্ত্বেও প্রচারণার অভাবে গত তিন বছর ধরে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ– ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) মাত্র তিনটি সিকিউরিটিজ নিয়ে এ বাজার চলছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রোকারেজ হাউজ লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে ডিএসইতে যাত্রা শুরু হয়েছিল এটিবি বোর্ডের। তখন প্রাণ এগ্রো লিমিটেড আনসিকিউরড গ্যারান্টেড বন্ড (পিএএলইউজিবি ওয়ান) ডেট সিকিউরিটিজ হিসেবে এই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে, পরবর্তী সময়ে ওই বন্ডের উদ্যোক্তা কর্তৃপক্ষ বন্ডটিকে এটিবিতে তালিকাভুক্ত করতে অনাগ্রহ দেখায়। অন্য স্টক এক্সচেঞ্জ সিএসইতে আইএফআইসি ব্যাংকের দুটি বন্ড তালিকাভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ দুই স্টক এক্সচেঞ্জে মাত্র তিনটি সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্ত রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে দেশে ব্যবসা করছে, ওইসব কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তরের জন্য এটিবি একটি বড় সম্ভাবনাময় প্ল্যাটফর্ম। এছাড়া, বন্ধ হয়ে যাওয়া ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটের যেসব কোম্পানি উৎপাদনে রয়েছে, সেগুলোর শেয়ারও এখানে লেনদেন হতে পারে। ডেবট সিকিউরিটিজ এবং বেমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটও এখানে লেনদেনের সুযোগ রাখা হয়েছে। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিকল্প লেনদেনের এই বাজারে কোনো গুরুত্বই দেয়নি স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। মূলত প্রচারণার অভাবেই তিন বছর অতিবাহিত হতে চললেও এই বাজারের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এটিবি যাদের জন্য সুযোগ ও সম্ভাবনাময়
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৫১৬টি। এর মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ৩ হাজার ৭৭৭টি। যার মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে তালিভুক্ত রয়েছে মাত্র ৩৬০টি। বাকি ৩ হাজার ৪১৭টি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কোম্পানিগুলো চাইলে তাদের শেয়ার মালিকানা এটিবিতে তালিকাভুক্ত হয়ে লেনদেন করতে পারবে। তবে, যেসব কোম্পানি পাবলিক লিমিটেড হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, সেগুলো এই প্ল্যাটফর্মে লেনদেন করতে পারবে না। এখানে তালিকাভুক্ত হতে অবশ্যই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হতে হবে।
এর বাইরে ওটিসি প্ল্যাটফর্মের আরও ৫৬টি কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোম্পানি উৎপাদনে থাকলে এবং ব্যবসায় ভালো করতে সক্ষম হলে সেগুলোরও এই প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ডেবট সিকিউরিটিজের মধ্যে কর্পোরেট বন্ড, ট্রেজারি বন্ড এবং ডিভেঞ্জারগুলোর এই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হয়ে মালিকানা হস্তান্তরের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব মিউচুয়াল ফান্ড (বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, সেগুলোও এই প্ল্যাটফর্মে লেনদেন করতে পারবে। পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন– ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর জন্যও মালিকানা হস্তান্তরের সুযোগ রয়েছে এই প্ল্যাটফর্মে।

এটিবিতে শেয়ার লেনদেনে কী ধরনের সুযোগ পাওয়া যায়
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্ল্যাটফর্মে শেয়ার লেনদেনে বড় অঙ্কের ট্যাক্স ছাড় পাওয়া যায়। এটিবিতে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার হস্তান্তরে স্ট্যাম্প ডিউটি ট্যাক্স দিতে হয় মাত্র ১০ পয়সা। যেখানে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোর ১০ টাকার শেয়ার হস্তান্তরে স্ট্যাম্প ডিউটি ট্যাক্স দিতে হয় আড়াই টাকা। ফলে এটিবিতে তালিকাভুক্ত হয়ে বড় অঙ্কের ট্যাক্স ছাড় পেতে পারে কোম্পানিগুলো। এ ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মে শেয়ার লেনদেনে ট্রান্সফার ফি ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটসহ বড় ধরনের খরচের বোঝাও কমে।
এর চেয়েও বড় বিষয় হলো কোম্পানিগুলোর মালিকানা হস্তান্তরে ঝামেলা কমাতে সহায়তা করে এটিবি। তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোকে শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ১১৭ ফরম পূরণ করতে আরজেএসসিতে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু এটিবিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই শেয়ার লেনদেন করা যায়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও টাস্কফোর্স যা বলছে
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাজারটি যেহেতু স্টক এক্সচেঞ্জের, সেহেতু এটির প্রচারণাও স্টক এক্সচেঞ্জকেই করতে হবে। পূর্বের কমিশনের মতো প্রচারণার ভার কমিশন আর নেবে না, এটি কমিশনের কাজও নয়। কোথাও অনিয়ম হলে সেটি দেখার দায়িত্ব কমিশনের। তাছাড়া বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন প্রয়োজন হলে কমিশন সেটি করবে। আমাদের টাস্কফোর্স এটিবি বোর্ড সংস্কারে কাজ করছে, তাদের সুপারিশ এলে কমিশন সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।’

পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এটিবি বোর্ডের কার্যক্রম বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ আমাদের কার্যতালিকায় রেখেছি। ধারাবাহিকভাবে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথমে মূল মার্কেটের সংস্কারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো শেষ হলে এটিবি, এসএমই বাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হবে।’

ডেস্ক রিপোর্ট 






















