বছরের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। যেখানে আগের সরকার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে চলত, সেখানে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উল্টো ব্যাংক ব্যবস্থায় আগের নেওয়া ঋণই পরিশোধ করছে। চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ না নিয়ে বরং আগের দেনা ফেরত দিচ্ছে—যা সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের নতুন ধারার স্পষ্ট উদাহরণ বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (৩০ জুন থেকে ৩০ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত) সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আগের নেওয়া ৫০৩ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই হিসেবে বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; এখন সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না, বরং আগের ঋণ পরিশোধ করছে।

চলতি বছরের ৩০ জুন শেষে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট নেট ঋণ ছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার ৯০৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা ৩০ অক্টোবর কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪০১ কোটি ৬৫ লাখ টাকায়। শুধু ৩০ অক্টোবর একদিনেই সরকারের নেট ঋণ কমেছে প্রায় ১,০০৯ কোটি টাকা। এর বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি ‘ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স’ ঋণ পরিশোধের কারণে। ওই দিন সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে ৮৯৯ কোটি টাকা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
অন্যদিকে, ব্যাংক ঋণ না নিয়ে সরকার ব্যাংক উৎস ছাড়া অন্য খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে সরকার। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নিট অবস্থান বাদ দিলে দেশীয় উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি নতুন ধারা। আগের সরকারের সময় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার ফলে বাজারে অতিরিক্ত টাকা প্রবাহিত হয়ে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর নতুন প্রশাসন রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এনেছে এবং ব্যয় সংযমে মনোযোগ দিয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ব্যাংক ঋণ কমার পেছনে অন্যতম কারণ হলো অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাতিল করা। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অগ্রাধিকারহীন বহু প্রকল্প স্থগিত বা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি চলমান অনেক উন্নয়ন প্রকল্পেও ব্যয়সংযম নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, ফলে ব্যয়ের গতি কমেছে। উন্নয়ন ব্যয়ের এই ধীরগতি ও প্রকল্প পর্যালোচনা প্রক্রিয়া সরকারের তহবিল চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে, যা ব্যাংক ঋণ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায় গত বছরের তুলনায় ভালো। সেই সঙ্গে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারের অবস্থান শক্ত হওয়ায় ব্যাংক ঋণ না নিয়ে উল্টো ঋণ পরিশোধ সম্ভব হয়েছে।
সরকারের ব্যাংক ঋণ কমা একদিকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাসে সহায়ক, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সুযোগ বাড়াচ্ছে। এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের গতি যদি দীর্ঘ সময় ধরে ধীর থাকে, তবে তা বিনিয়োগ স্থবিরতা ও প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

ডেস্ক রিপোর্ট 






















