ঢাকা ০৩:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

বিশ্ব শিক্ষক দিবস: শিক্ষকতা—মানবতার শ্রেষ্ঠ সেবা ও জাতির অমর গৌরব

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ০৭:০৪:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫
  • ২৭ বার দেখা হয়েছে

জুবাইয়া বিন্তে কবির:

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। পৃথিবীর সমস্ত আলো জ্বালানো সেই মহান আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন, যারা নিঃশব্দে, অক্লান্ত পরিশ্রমে এক একটি হৃদয়ে জ্যোতির্ময় আলো ছড়িয়ে দেন—শিক্ষকরা। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি এক মহান ব্রত, এক মানবতাবোধের অঙ্গীকার, যা জীবনের অন্ধকারকে আলোর দিশায় রূপান্তরিত করে। শিক্ষক হচ্ছেন জাতির মা-মহিমা, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে বপন করেন জ্ঞান, চরিত্র ও মানবিকতার বীজ। তাদের হাতে গড়া প্রতিটি শিশুর হৃদয়ে জাগে আশা, স্বপ্ন আর উন্নতির পিপাসা। তারা শুধু বইয়ের পাঠ নয়, জীবনের পাঠ শেখান—বিপদ-সঙ্কটে দৃঢ় থাকার সাহস, অসুবিধার অন্ধকারে আলোর সন্ধান। বাংলার প্রতিটি কোণে, প্রত্যেকটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গী, যিনি জীবনের প্রতিটি বাঁকে প্রেরণা হয়ে দাঁড়ান। আজকের দিনে তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা শুধু শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং তাদের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি।

শিক্ষকের অপূর্ণতা ও দায়িত্বের বহুমাত্রিকতা : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা স্তরে বিভক্ত। সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিও শিক্ষকসহ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক, প্রত্যেকের অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধা পৃথক হলেও, শিক্ষাদানের মূল দায়িত্ব সকলের জন্য অভিন্ন। তবে প্রত্যেক স্তরে শিক্ষাদানের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন মাত্রার। বিশেষ করে নন-এমপিও শিক্ষকরা অনেক সময় সুবিধাহীনতায় আক্রান্ত হন। তবু এই বহু অপূর্ণতার মাঝেও শিক্ষকদের মনে থাকে এক অপার তৃপ্তি — শিক্ষার্থীদের শেখানো এবং তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার আনন্দ। অন্য পেশার তুলনায় শিক্ষকতা পেশাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ এখানে শুধু পেশাগত নয়, মানবিক দায়বদ্ধতাও জড়িয়ে থাকে। একজন শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলেন, তাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সময়ের সঙ্গে তিনি নিজেকে ধারালো করে তোলেন যেন শিক্ষার্থীদের প্রতি সঠিক দিশা দেখাতে পারেন। শিক্ষক সমাজ হলো সমাজ পরিবর্তনের মূল কারিগর। শিক্ষক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী এই তিনটি শব্দ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষকবিহীন শিক্ষা কল্পনাই করা যায় না, যেমন শিক্ষাবিহীন ছাত্র জীবনের অন্ধকারে পথ হারায়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও মনোবল প্রদান করেন।

আজীবন শিক্ষার্থী: একজন শিক্ষক : একজন প্রকৃত শিক্ষক নিজেকে আজীবন ছাত্র মনে করেন। জ্ঞানের প্রতি তাদের তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজের জ্ঞান অর্জন ছাড়া অন্যকে কী শেখানো যায়? তাই শিক্ষকরা নিয়মিত পড়াশোনা করেন, নতুন নতুন বিষয় শিখেন এবং তা ছাত্রদের মাঝে পৌঁছে দেন। এই প্রক্রিয়াটি কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য। শিক্ষকের সফলতা নির্ণয় করা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়, কারণ তার কাজের ফলাফল প্রায় সময় দীর্ঘমেয়াদি হয়। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানকারী নন, তিনি পরামর্শদাতা, শিক্ষা সহায়ক ব্যক্তি, রোল মডেল, সমাজের দর্পণ, কারিকুলাম প্রস্তুতকারক, মূল্যায়নকারী, শিক্ষা সংগঠক ও নির্দেশক— এই সব গুণাবলীর অধিকারী। তাই শিক্ষকদের বলা হয় ‘অতিমানব’। তারা সাধারণ মানুষ হলেও অসাধারণ মানুষ তৈরি করেন। শিক্ষা কোনো পেশা নয়, এটি একটি ব্রত, একটি সেবা, যা জাতির গঠন ও সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে।

শিক্ষকের দায়িত্ব ও মর্যাদা : শিক্ষকের কাজ শুধু সিলেবাস শেষ করা নয়। শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা উদ্ভাবন করাও শিক্ষকের দায়িত্ব। এজন্য তার প্রয়োজন দক্ষতা, ধৈর্য, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অসাধু শিক্ষকের কারণে সমগ্র পেশা সমালোচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু একটি পেশার গুণগত মান বিচার করা যাবে না কয়েকটি ভুলের কারণে। প্রকৃত শিক্ষক হলেন যিনি ছাত্রের জীবনে ইতিবাচক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। শিক্ষকতা পেশায় যোগদান কেবল পেশাগত সনদ দিয়ে হয় না, প্রয়োজন মানবিক গুণাবলী ও পেশাগত নিষ্ঠা। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর হৃদয়ে বাস করেন, তাদের আদর্শের রূপকার হন। শিক্ষকতার সাফল্য নির্ভর করে কতজন শিক্ষার্থীর জীবনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার উপর।

শিক্ষক ও সমাজ: পার্থক্য ও সম্পর্ক : শিক্ষক এবং সমাজের অন্য পেশার মানুষের মধ্যে পার্থক্য অপরিসীম। অন্যান্য পেশার মানুষ যেমন মাত্র একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে, শিক্ষককে অনেক গুণের সমাহার হতে হয়। সে কারণেই শিক্ষকতাকে পেশা না বলে সেবা হিসেবে দেখা হয়। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। তবুও শিক্ষক সমাজের চাহিদা পূরণে আরও কাজ করা প্রয়োজন।

আমার ব্যক্তিগত সংযোগ: শিক্ষকতা ও পরিবার : আমি নিজেও বরিশালের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ। আমার স্বামী, বোন, ননদ, শ্বশুরসহ বহু আত্মীয় শিক্ষক পেশায় নিয়োজিত। তাদের মধ্যে থেকে শিখেছি শিক্ষকতা শুধুমাত্র চাকরি নয়, এটি হলো পবিত্র এক ব্রত, সমাজ ও জাতির প্রতি এক মহৎ দায়িত্ব। আমার পরিবারে শিক্ষকতা পেশার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা রয়েছে, তা আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা। পরিবারের এই প্রেরণা আমাকে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

শিক্ষকের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা :
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না। তাদের আকর্ষণ বেশি হয় ডাক্তারি, প্রকৌশল ও সরকারি চাকরির প্রতি। এর মূল কারণ হলো শিক্ষকতা পেশার বেতন ও মর্যাদা অন্য পেশার তুলনায় কম। উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষকই বেতন ও মর্যাদায় শীর্ষে থাকে এবং সেখানে শিক্ষকের প্রতি সম্মান অত্যন্ত বেশি। আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া ভালো শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। এজন্য সরকার ও সমাজকে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও উন্নত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকের নৈতিক চরিত্র ও সততা : শিক্ষকরা শুধু যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে তৈরি হন না; নৈতিকতা, সততা ও মানবিক গুণাবলীর মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষক সৃষ্টি হয়। সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষকত্ব শুরু হলেও, চরিত্র বিকাশ ছাড়াই শিক্ষক হওয়া যায় না। একটি জাতির মান ও মর্যাদা নির্ভর করে তার শিক্ষকদের গুণগত মানের ওপর।

শিক্ষকের দায়িত্ব: শুধু পাঠদান নয়, আদর্শ গঠন : শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয় শেখান না, তারা শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সামাজিক আচরণ, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা গড়ে তোলেন। একটি জাতি যেখানে শিক্ষকের মর্যাদা আছে, সেখানে উন্নয়ন ও অগ্রগতি অটুট থাকে। শিক্ষক আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও সংকল্পের বীজ বপন করেন, যা সমাজের ভবিষ্যৎ গঠনে অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্ব শিক্ষক দিবস : ১৯৪৭ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। ১৯৫২ সালে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়ন হয়, যা শিক্ষকদের দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ করে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি শিক্ষকদের সম্মান ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। ২০২৫ সালের থিম ‘Teachers: Leading in Crisis, Reimagining the Future’ আমাদের শিক্ষক সমাজকে সংকট মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানায়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা: একটি বিশ্লেষণ : দবাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি এগুলো বড় অর্জন। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য, শিক্ষক অধিকারের অভাব ও পেশাগত অসন্তোষ এখনও বিদ্যমান।
১৯৮০ সালের আগে বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো সংহত কর্মসংস্থান ব্যবস্থা ছিল না, ফলে তাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সেসময় থেকে আন্দোলন ও প্রজ্ঞানের মাধ্যমে আজকের অবস্থান এসেছে। বেতনস্কেল ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এখনও শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তায় শিথিলতা রয়েছে।

শিক্ষকদের করণীয় ও সমাজের দায়িত্ব : শিক্ষকদের উচিত নিজেদের পেশাগত দক্ষতা ও চরিত্র উন্নয়নে অবিরত কাজ করা। নিজেদেরকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলা জরুরি। সামাজিক ও মানসিক সম্মান বজায় রাখা তাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
সমাজ ও সরকারকেও শিক্ষকদের জন্য উন্নত পরিবেশ, যথাযথ প্রশিক্ষণ, ন্যায্য বেতন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতের দেশ গড়তে সক্ষম হব।

পরিশেষে, শিক্ষকতা পেশা কেবল চাকরি নয়, এটি জাতির প্রতি সেবা ও কর্তব্যের মহাপ্রতিশ্রুতি। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জীবনে যে আলো ছড়ায় তা দেশের অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে জাতির উন্নয়ন থমকে যাবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শিক্ষকদের অবদানের মূল্য ও তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ। আসুন, আমরা সবাই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি, তাদের পেশাগত ও সামাজিক অধিকার রক্ষায় কাজ করি এবং দেশের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একযোগে এগিয়ে চলি। কারণ শিক্ষকের হাতে লিপিবদ্ধ থাকে জাতির ভবিষ্যৎ, এবং শিক্ষার আলোতেই দীপ্ত হয় আমাদের প্রজন্মের জীবন।

লেখক পরিচিতি : জুবাইয়া বিন্তে কবির
গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী
প্রশিক্ষক, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বরিশাল।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস: শিক্ষকতা—মানবতার শ্রেষ্ঠ সেবা ও জাতির অমর গৌরব

প্রকাশিত : ০৭:০৪:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

জুবাইয়া বিন্তে কবির:

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। পৃথিবীর সমস্ত আলো জ্বালানো সেই মহান আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন, যারা নিঃশব্দে, অক্লান্ত পরিশ্রমে এক একটি হৃদয়ে জ্যোতির্ময় আলো ছড়িয়ে দেন—শিক্ষকরা। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি এক মহান ব্রত, এক মানবতাবোধের অঙ্গীকার, যা জীবনের অন্ধকারকে আলোর দিশায় রূপান্তরিত করে। শিক্ষক হচ্ছেন জাতির মা-মহিমা, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে বপন করেন জ্ঞান, চরিত্র ও মানবিকতার বীজ। তাদের হাতে গড়া প্রতিটি শিশুর হৃদয়ে জাগে আশা, স্বপ্ন আর উন্নতির পিপাসা। তারা শুধু বইয়ের পাঠ নয়, জীবনের পাঠ শেখান—বিপদ-সঙ্কটে দৃঢ় থাকার সাহস, অসুবিধার অন্ধকারে আলোর সন্ধান। বাংলার প্রতিটি কোণে, প্রত্যেকটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গী, যিনি জীবনের প্রতিটি বাঁকে প্রেরণা হয়ে দাঁড়ান। আজকের দিনে তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা শুধু শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং তাদের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি।

শিক্ষকের অপূর্ণতা ও দায়িত্বের বহুমাত্রিকতা : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা স্তরে বিভক্ত। সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিও শিক্ষকসহ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক, প্রত্যেকের অবস্থান ও সুযোগ-সুবিধা পৃথক হলেও, শিক্ষাদানের মূল দায়িত্ব সকলের জন্য অভিন্ন। তবে প্রত্যেক স্তরে শিক্ষাদানের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন মাত্রার। বিশেষ করে নন-এমপিও শিক্ষকরা অনেক সময় সুবিধাহীনতায় আক্রান্ত হন। তবু এই বহু অপূর্ণতার মাঝেও শিক্ষকদের মনে থাকে এক অপার তৃপ্তি — শিক্ষার্থীদের শেখানো এবং তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার আনন্দ। অন্য পেশার তুলনায় শিক্ষকতা পেশাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ এখানে শুধু পেশাগত নয়, মানবিক দায়বদ্ধতাও জড়িয়ে থাকে। একজন শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলেন, তাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সময়ের সঙ্গে তিনি নিজেকে ধারালো করে তোলেন যেন শিক্ষার্থীদের প্রতি সঠিক দিশা দেখাতে পারেন। শিক্ষক সমাজ হলো সমাজ পরিবর্তনের মূল কারিগর। শিক্ষক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী এই তিনটি শব্দ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষকবিহীন শিক্ষা কল্পনাই করা যায় না, যেমন শিক্ষাবিহীন ছাত্র জীবনের অন্ধকারে পথ হারায়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও মনোবল প্রদান করেন।

আজীবন শিক্ষার্থী: একজন শিক্ষক : একজন প্রকৃত শিক্ষক নিজেকে আজীবন ছাত্র মনে করেন। জ্ঞানের প্রতি তাদের তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজের জ্ঞান অর্জন ছাড়া অন্যকে কী শেখানো যায়? তাই শিক্ষকরা নিয়মিত পড়াশোনা করেন, নতুন নতুন বিষয় শিখেন এবং তা ছাত্রদের মাঝে পৌঁছে দেন। এই প্রক্রিয়াটি কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য। শিক্ষকের সফলতা নির্ণয় করা খুবই সূক্ষ্ম বিষয়, কারণ তার কাজের ফলাফল প্রায় সময় দীর্ঘমেয়াদি হয়। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানকারী নন, তিনি পরামর্শদাতা, শিক্ষা সহায়ক ব্যক্তি, রোল মডেল, সমাজের দর্পণ, কারিকুলাম প্রস্তুতকারক, মূল্যায়নকারী, শিক্ষা সংগঠক ও নির্দেশক— এই সব গুণাবলীর অধিকারী। তাই শিক্ষকদের বলা হয় ‘অতিমানব’। তারা সাধারণ মানুষ হলেও অসাধারণ মানুষ তৈরি করেন। শিক্ষা কোনো পেশা নয়, এটি একটি ব্রত, একটি সেবা, যা জাতির গঠন ও সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে।

শিক্ষকের দায়িত্ব ও মর্যাদা : শিক্ষকের কাজ শুধু সিলেবাস শেষ করা নয়। শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা উদ্ভাবন করাও শিক্ষকের দায়িত্ব। এজন্য তার প্রয়োজন দক্ষতা, ধৈর্য, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অসাধু শিক্ষকের কারণে সমগ্র পেশা সমালোচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু একটি পেশার গুণগত মান বিচার করা যাবে না কয়েকটি ভুলের কারণে। প্রকৃত শিক্ষক হলেন যিনি ছাত্রের জীবনে ইতিবাচক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। শিক্ষকতা পেশায় যোগদান কেবল পেশাগত সনদ দিয়ে হয় না, প্রয়োজন মানবিক গুণাবলী ও পেশাগত নিষ্ঠা। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর হৃদয়ে বাস করেন, তাদের আদর্শের রূপকার হন। শিক্ষকতার সাফল্য নির্ভর করে কতজন শিক্ষার্থীর জীবনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার উপর।

শিক্ষক ও সমাজ: পার্থক্য ও সম্পর্ক : শিক্ষক এবং সমাজের অন্য পেশার মানুষের মধ্যে পার্থক্য অপরিসীম। অন্যান্য পেশার মানুষ যেমন মাত্র একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে, শিক্ষককে অনেক গুণের সমাহার হতে হয়। সে কারণেই শিক্ষকতাকে পেশা না বলে সেবা হিসেবে দেখা হয়। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। তবুও শিক্ষক সমাজের চাহিদা পূরণে আরও কাজ করা প্রয়োজন।

আমার ব্যক্তিগত সংযোগ: শিক্ষকতা ও পরিবার : আমি নিজেও বরিশালের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একজন প্রশিক্ষক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ। আমার স্বামী, বোন, ননদ, শ্বশুরসহ বহু আত্মীয় শিক্ষক পেশায় নিয়োজিত। তাদের মধ্যে থেকে শিখেছি শিক্ষকতা শুধুমাত্র চাকরি নয়, এটি হলো পবিত্র এক ব্রত, সমাজ ও জাতির প্রতি এক মহৎ দায়িত্ব। আমার পরিবারে শিক্ষকতা পেশার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা রয়েছে, তা আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা। পরিবারের এই প্রেরণা আমাকে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

শিক্ষকের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা :
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না। তাদের আকর্ষণ বেশি হয় ডাক্তারি, প্রকৌশল ও সরকারি চাকরির প্রতি। এর মূল কারণ হলো শিক্ষকতা পেশার বেতন ও মর্যাদা অন্য পেশার তুলনায় কম। উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষকই বেতন ও মর্যাদায় শীর্ষে থাকে এবং সেখানে শিক্ষকের প্রতি সম্মান অত্যন্ত বেশি। আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া ভালো শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। এজন্য সরকার ও সমাজকে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও উন্নত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকের নৈতিক চরিত্র ও সততা : শিক্ষকরা শুধু যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে তৈরি হন না; নৈতিকতা, সততা ও মানবিক গুণাবলীর মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষক সৃষ্টি হয়। সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষকত্ব শুরু হলেও, চরিত্র বিকাশ ছাড়াই শিক্ষক হওয়া যায় না। একটি জাতির মান ও মর্যাদা নির্ভর করে তার শিক্ষকদের গুণগত মানের ওপর।

শিক্ষকের দায়িত্ব: শুধু পাঠদান নয়, আদর্শ গঠন : শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয় শেখান না, তারা শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সামাজিক আচরণ, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা গড়ে তোলেন। একটি জাতি যেখানে শিক্ষকের মর্যাদা আছে, সেখানে উন্নয়ন ও অগ্রগতি অটুট থাকে। শিক্ষক আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও সংকল্পের বীজ বপন করেন, যা সমাজের ভবিষ্যৎ গঠনে অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্ব শিক্ষক দিবস : ১৯৪৭ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। ১৯৫২ সালে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ‘শিক্ষক সনদ’ প্রণয়ন হয়, যা শিক্ষকদের দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ করে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি শিক্ষকদের সম্মান ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। ২০২৫ সালের থিম ‘Teachers: Leading in Crisis, Reimagining the Future’ আমাদের শিক্ষক সমাজকে সংকট মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিয়ে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানায়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা: একটি বিশ্লেষণ : দবাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি এগুলো বড় অর্জন। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈষম্য, শিক্ষক অধিকারের অভাব ও পেশাগত অসন্তোষ এখনও বিদ্যমান।
১৯৮০ সালের আগে বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো সংহত কর্মসংস্থান ব্যবস্থা ছিল না, ফলে তাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সেসময় থেকে আন্দোলন ও প্রজ্ঞানের মাধ্যমে আজকের অবস্থান এসেছে। বেতনস্কেল ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এখনও শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তায় শিথিলতা রয়েছে।

শিক্ষকদের করণীয় ও সমাজের দায়িত্ব : শিক্ষকদের উচিত নিজেদের পেশাগত দক্ষতা ও চরিত্র উন্নয়নে অবিরত কাজ করা। নিজেদেরকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলা জরুরি। সামাজিক ও মানসিক সম্মান বজায় রাখা তাদের অপরিহার্য কর্তব্য।
সমাজ ও সরকারকেও শিক্ষকদের জন্য উন্নত পরিবেশ, যথাযথ প্রশিক্ষণ, ন্যায্য বেতন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতের দেশ গড়তে সক্ষম হব।

পরিশেষে, শিক্ষকতা পেশা কেবল চাকরি নয়, এটি জাতির প্রতি সেবা ও কর্তব্যের মহাপ্রতিশ্রুতি। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জীবনে যে আলো ছড়ায় তা দেশের অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে জাতির উন্নয়ন থমকে যাবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শিক্ষকদের অবদানের মূল্য ও তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ। আসুন, আমরা সবাই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি, তাদের পেশাগত ও সামাজিক অধিকার রক্ষায় কাজ করি এবং দেশের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একযোগে এগিয়ে চলি। কারণ শিক্ষকের হাতে লিপিবদ্ধ থাকে জাতির ভবিষ্যৎ, এবং শিক্ষার আলোতেই দীপ্ত হয় আমাদের প্রজন্মের জীবন।

লেখক পরিচিতি : জুবাইয়া বিন্তে কবির
গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী
প্রশিক্ষক, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বরিশাল।