জুবাইয়া বিন্তে কবির:
নেতা শব্দটির ভেতরেই লুকিয়ে আছে আস্থা, দায়িত্ব ও অনুপ্রেরণার অদৃশ্য আলো। একজন মানুষ যখন সাধারণের কাছ থেকে নেতৃত্বের স্বীকৃতি লাভ করেন, তখন তিনি আর কেবল নিজে থাকেন না—তিনি হয়ে ওঠেন অগণিত চোখের সামনে দাঁড়ানো এক প্রতীক। তার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তার নীরবতাও হয়ে ওঠে বার্তা; হয়ে ওঠে অনুসরণের পথ। একজন নেতা কেবল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতার জন্যই নেতা নন, বরং নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব, শৃঙ্খলা ও সততার জন্যও তিনি সমাজের সামনে দিশারী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা যেন ভিন্ন গল্প বলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ক্রল করতে করতে আমরা প্রায়ই এমন কিছু দৃশ্য দেখতে পাই যা আমাদের হতাশা, ক্ষোভ ও প্রশ্নে ভরিয়ে তোলে। দেশের নানা প্রান্তে, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় একের পর এক ভাইরাল হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের মাদক সেবনের ভিডিও। কখনো দেখা যাচ্ছে, আয়েশি ভঙ্গিতে নেশার ধোঁয়া ছাড়ছেন কেউ; কখনোবা গোপন আসরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আসক্তির গভীরে ডুবে যাচ্ছেন। এইসব দৃশ্য সামনে এলে শুধু নেতার নয়, পুরো সমাজের উপর যেন এক অন্ধকার ছায়া নেমে আসে।
ব্যক্তিগত না সামাজিক? অনেকে প্রশ্ন তোলেন—এগুলো কি কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতা, নাকি এর সামাজিক প্রভাবও আছে? এখানে বিতর্ক উঠতে পারে গোপনীয়তা নিয়ে। কেননা, বেশিরভাগ সময় এমন ভিডিও প্রকাশ করে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা ব্যক্তিগত সহকারী। হতে পারে ব্যক্তিগত শত্রুতা, দলীয় ক্ষমতার লড়াই, অথবা প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যেভাবেই হোক, একবার দৃশ্যটি জনসম্মুখে এলে বাস্তবতাকে আর আড়াল করা যায় না। মানুষের সামনে তখন নেতার আসল রূপ প্রকাশিত হয়। একজন সাধারণ মানুষ যদি মাদকে জড়িয়ে পড়েন, তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক, কিন্তু সেটি তার ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতা যখন আসক্তিতে নিমজ্জিত হন, তখন সেটি আর কেবল তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা থাকে না—তা হয়ে দাঁড়ায় এক ভয়াবহ সামাজিক বার্তা। কারণ নেতার জীবনকে মানুষ অনুসরণ করে, তার কথাকে ধরে নেয় নীতি হিসেবে, আর তার আচরণ হয়ে ওঠে সামাজিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।
নেতৃত্বের মর্যাদা ও মাদকের আঘাত : নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতার চেয়ারে বসা নয়; নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, আত্মসংযম, জনগণের আস্থার প্রতিফলন। জনগণ যখন ভোট দিয়ে কাউকে নেতা বানায়, তখন তারা নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ নেতার হাতে তুলে দেয়। সেই আস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার নামই হলো মাদকাসক্তি। একজন নেতা যখন নেশায় মত্ত হন, তখন তিনি কেবল নিজের শরীরকেই বিষিয়ে তুলছেন না; তিনি নষ্ট করছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক শক্তিকেও। তরুণেরা যখন দেখে—নেতা নিজেই আসক্ত, তখন তাদের ভেতরে প্রশ্ন জন্ম নেয়: “যদি তিনি পারেন, তবে আমি কেন পারব না?” এভাবেই সমাজে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তির বিষ, দুর্বল হয়ে পড়ে নৈতিকতা, আর ভেঙে যায় মূল্যবোধের স্তম্ভ।
সমাজের প্রতি দায় : আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—নেতা কখনো একা চলেন না। তিনি হাঁটেন হাজার মানুষের দৃষ্টির ভেতর দিয়ে। তার পোশাক, তার কথাবার্তা, তার আচার-আচরণ সবই হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। তাই তার প্রতিটি ভুল যেন সমাজের গায়ে দাগ ফেলে যায়। আমাদের সমাজে এখন যে চিত্র ফুটে উঠছে, তা ভীষণ উদ্বেগজনক। মাদক কেবল একজনের স্বপ্নকে নষ্ট করছে না; এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুর্বল করছে, প্রশাসনিক কাঠামোকে ভেতর থেকে ক্ষয়ে দিচ্ছে। মাদকাসক্ত নেতা যখন কোনো পদে থাকেন, তখন তিনি নিজে দুর্বল হয়ে পড়েন অপরাধচক্রের হাতে। মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধীরা তখন তাকে দিয়ে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করে, আর আইনের প্রয়োগকেও ভোঁতা বানিয়ে দেয়।
রাজনৈতিক দলের দায় : শুধু ব্যক্তি নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকেও ভাবতে হবে। আজকাল প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আমরা দেখি বক্তৃতার জোর, জনপ্রিয়তার ঢেউ কিংবা টাকার প্রভাবকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু চরিত্র, সততা ও ব্যক্তিগত জীবনের স্বচ্ছতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া কোথায়? যে নেতা দলের ভেতরে শৃঙ্খলা মানেন না, যিনি মাদক বা অন্য অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়েন, তাকে কীভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা যায়? রাজনীতিকে যদি সত্যিকার অর্থে শুদ্ধ করতে হয়, তবে প্রার্থীদের মনোনয়নের সময় কঠোর যাচাই-বাছাই অপরিহার্য। শুধু বক্তৃতার ঝলক নয়; চরিত্রের দীপ্তিই হতে হবে নেতৃত্ব নির্বাচনের মূল ভিত্তি। আর যদি কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন, তবে দলকে নির্দ্বিধায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে—যেমন কিছু ক্ষেত্রে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় উদাসীনতা আসলে জনগণের আস্থাকে ভেঙে দেয়।
জনগণের ভূমিকা : এখানে জনগণেরও বড় দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রায়ই দেখি—অন্ধ সমর্থনে কোনো নেতাকে এতটাই মহিমান্বিত করা হয় যে তিনি মনে করেন, তার সবকিছুই ক্ষমাযোগ্য। এভাবে জন্ম নেয় দায়হীনতা। অথচ জনগণের উচিত সঠিক মূল্যায়ন করা—কে সত্যিকার নীতিবান, কে সৎ, কে নিজের জীবনকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম। সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম—সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে মাদকবিরোধী আন্দোলনে। শুধু স্লোগান নয়, বাস্তব প্রয়োগ দরকার। আইন কঠোরভাবে কার্যকর হতে হবে, আবার নৈতিকতার চর্চাকেও করতে হবে জীবনের অংশ।
মাদক: ব্যক্তিগত থেকে রাজনৈতিক সংকটে :
একসময় হয়তো মাদককে কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম উৎস। একজন আসক্ত ব্যক্তি কেবল নিজের জীবনকেই ধ্বংস করেন না, বরং তিনি হয়ে ওঠেন অপরাধচক্রের অংশীদার। মাদকাসক্ত নেতা প্রশাসনিক কাজে ব্যর্থ হন, অপরাধীদের প্রশ্রয় দেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এর ফলশ্রুতিতে সমাজে জন্ম নেয় অস্থিরতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি।
প্রকৃত নেতৃত্বের রূপ : নেতৃত্বের প্রকৃত রূপ আসলে খুব সহজ। তিনি নেতা, যিনি নিজের জীবনকে অন্যদের সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। তিনি নেতা, যিনি আস্থার প্রতীক, দায়িত্বের প্রতিমূর্তি। তিনি নেতা, যিনি তরুণ প্রজন্মকে দেখান—মাদক নয়, সততা ও শৃঙ্খলাই জীবনের সঠিক পথ।
সত্যিকার নেতার প্রয়োজন আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমরা যদি চোখ-কান খোলা না রাখি, তবে ভুয়া নেতৃত্ব সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে। তাই জনগণকে সচেতন হতে হবে, সঠিক নেতাকে বেছে নিতে হবে, আর মাদকাসক্তদের প্রতি কঠোর হতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান : ভাইরাল ভিডিও কয়েক দিনের জন্য আলোচনার ঝড় তোলে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। কিন্তু সমাজের ভেতরের সমস্যাটা থেকে যায়। তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা ও উদ্যোগ। শিক্ষা, পরিবার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কেবল আইন নয়, সংস্কৃতিও বদলাতে হবে।
আমরা চাই—একটি মাদকমুক্ত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। নেতৃত্বের আসল পরিচয় হোক সততা, নৈতিকতা আর জনগণের সেবার মানসিকতা।
পরিশেষে, মাদক আজ কেবল একটি ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; এটি আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি। একজন নেতা যখন মাদকে জড়িয়ে পড়েন, তখন তিনি ভেঙে দেন আস্থার প্রাচীর, ধ্বংস করেন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আমাদের মনে রাখতে হবে—নেতৃত্বের মানে কেবল ক্ষমতা নয়। নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব, আত্মসংযম, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। একজন নেতা তখনই সত্যিকারের নেতা, যখন তিনি নিজের জীবনে সততা ও শৃঙ্খলা ধরে রেখে অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তাই আজ আমাদের প্রত্যয় হোক—নেতৃত্বের প্রতীক হবেন তারা-ই, যারা নিজেদের জীবনকে আলোকিত রাখবেন। মাদক নয়, সততা ও দায়িত্ববোধই হোক নেতৃত্বের আসল পরিচয়। তখনই নিরাপদ হবে সমাজ, তখনই আলোকিত হবে ভবিষ্যৎ।
লেখক পরিচিতি : জুবাইয়া বিন্তে কবির
গবেষক কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।