ঢাকা ০১:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ: ন্যায়ের পথে আলোর কারিগর

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ০৯:৩৩:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ নভেম্বর ২০২৫
  • ২ বার দেখা হয়েছে

জুবাইয়া বিন্তে কবির:

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল—সমুদ্র ও সবুজে ঘেরা পটুয়াখালী, যার বুক চিরে উঠেছে এক অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি)। প্রযুক্তি, কৃষি, মৎস্য, ব্যবসা প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি—সব অনুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে যেভাবে বিকশিত হয়েছে আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, তা আজ দেশের উচ্চশিক্ষায় এক উজ্জ্বল সংযোজন।

আইনশিক্ষা: মানবতার পথে এক অনন্ত যাত্রা: সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে মানুষ ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত। সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং মানবিক মূল্যবোধকে লালন করতে আইনই মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়া মানে শুধু পেশার প্রস্তুতি নয়—এটি এক নৈতিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রা। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ এই মানবিক বোধকে বাস্তবতার মাটিতে রোপণ করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল সংবিধান, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন শেখে না; শেখে কীভাবে আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।

ভূমি প্রশাসন: সময়ের দাবি : বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ভূমির সঙ্গে। কিন্তু এই ভূমিই আজ অনেক সময় হয়ে ওঠে বিবাদের কারণ—মামলার বোঝা, দখল, জাল দলিল, বা সীমারেখা নিয়ে অনন্ত দ্বন্দ্ব। এই প্রেক্ষাপটে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইনি জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। দেশে এখন প্রায় ৭০ শতাংশ মামলাই ভূমি-সংক্রান্ত। তাই ভূমি আইন জানা একজন আইনি পেশাজীবীর জন্য অপরিহার্য দক্ষতা। এখানেই পবিপ্রবির এই অনুষদ সময়ের চাহিদা মেটাতে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে।

অনুষদটির ডিনের দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর মো. জামাল হোসেন এবং অনুষদে কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোঃ সাইদুর রহমান জুয়েল। ডিন প্রফেসর মো. জামাল হোসেন বলেন, “আমাদের লক্ষ্য কেবল পেশাদার আইনবিদ তৈরি করা নয়; এমন নাগরিক তৈরি করা যারা মানবতার সেবা করবে। শিক্ষার্থীরা যেন আইনের নৈতিক দিকটি অনুধাবন করতে পারে, সেটিই আমরা গুরুত্ব দিই।”

শিক্ষকবৃন্দ: জ্ঞানের আলোকবর্তিকা : এই অনুষদের শিক্ষকেরা শুধু একাডেমিক নয়, সমাজ সচেতন গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পথ দেখান। এই অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. আব্দুর রহিম, এছাড়াও রয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক মো. রেজাউল ইসলাম মাসুম, সহকারী অধ্যাপক মো. রহমত সরকার, সউদ বিন আলম প্রতীক এবং প্রভাষক পদে রয়েছেন আমিনা সারওয়ার—তাঁরা আইনের জটিল ধারণাকে সহজভাবে উপস্থাপন করেন।

সহযোগী অধ্যাপক মো. মাসুম বিল্লাহ এবং সহকারী অধ্যাপক মোঃ সউদ বিন আলম প্রতিক বলেন, “ভূমি প্রশাসন বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বহুমাত্রিক দিগন্ত খুলে দেয়। তারা আদালত, প্রশাসন, কর্পোরেট ক্ষেত্র, এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও কাজ করতে সক্ষম হয়। এবং আমাদের পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে তত্ত্ব ও প্রয়োগ—দুটিই সমান গুরুত্ব পায়। শিক্ষার্থীরা মাঠপর্যায়ে ভূমি প্রশাসনের বাস্তব কার্যক্রম বুঝতে পারে, আবার আদালতের কাঠামোতেও দক্ষ হয়ে ওঠে।”

পবিপ্রবির সম্মানিত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. ইকতিয়ার উদ্দিন বলেন, “এই অনুষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষতার নতুন উদাহরণ। আইনশিক্ষা মানে কেবল তত্ত্ব নয়—এটি নেতৃত্ব, দায়িত্ব ও নৈতিকতার শিক্ষা। পবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা এখন শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ আইনবিদ হিসেবে নিজেদের তৈরি করছে।” তিনি আরও বলেন, “ভূমি প্রশাসন ও আইন একত্রে শেখানো হচ্ছে বলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের নীতি-নির্ধারণ, সরকারি প্রশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।”

কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবদুল লতিফ বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নির্ভর করে জ্ঞানের বৈচিত্র্যের উপর। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ শিক্ষায় বৈচিত্র্য এনেছে। এখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞান ও আইনের মেলবন্ধন ঘটেছে—যা শিক্ষার্থীদের সমন্বিত চিন্তাশক্তি গড়ে তোলে।” তিনি আরও বলেন, “এই অনুষদ দেশের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থায় যে দক্ষ জনবল তৈরি করছে, তা একদিন জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত বলেন, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আইনের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আইনি জ্ঞান, সাইবার আইন, ডেটা প্রাইভেসি ও অনলাইন বিচারব্যবস্থার বিষয়ে ধারণা দিচ্ছে। এটি ভবিষ্যতের আইন শিক্ষার দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদ সময়ের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলছে। আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ সেই ধারাবাহিকতার এক অসাধারণ উদাহরণ।”

ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু ডিগ্রির কারখানা নয়; এটি চিন্তার কারখানা। আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ সেই চিন্তারই প্রতিফলন। এখানে আমরা এমন আইনবিদ তৈরি করছি, যারা ন্যায়বিচারের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে।” তিনি আরও বলেন, “ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম বাধা। তাই এই অনুষদ শুধু শিক্ষায় নয়, জাতির উন্নয়ন কাঠামোতেও অবদান রাখছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—পবিপ্রবি থেকে একদিন বের হবে এমন এক প্রজন্ম, যারা ন্যায়, সত্য ও দায়িত্ববোধে বিশ্বকে বদলে দেবে।”

গবেষণা ও আধুনিক পাঠক্রম : পবিপ্রবির এই অনুষদে শিক্ষার্থীরা শুধু বইয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। তারা অংশ নেয় মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা, লিগ্যাল ক্লিনিক, এবং রিসার্চ কনফারেন্সে। এখানে তৈরি হয় বিচারিক ভাষার দক্ষতা, বিশ্লেষণক্ষমতা, এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। আইন ও ভূমি প্রশাসনের সমন্বিত পাঠ্যক্রমে যুক্ত রয়েছে—

ভূমি জরিপ, রিয়েল প্রোপার্টি ল, এনভায়রনমেন্টাল ল, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস এবং সাইবার ল’-এর মতো আধুনিক কোর্স। ক্যারিয়ার সম্ভাবনা: বিস্তৃত দিগন্ত পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের শিক্ষার্থীরা দেশের ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তারা সুযোগ পাচ্ছে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে, প্রশাসন ক্যাডারে, কর্পোরেট ল’ ফার্মে, লিগ্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়। শিক্ষার্থী মায়মুনা জায়রা বলেন, “আমাদের কোর্স এমনভাবে সাজানো যে, আমরা একসঙ্গে বিসিএস, বিজেএস ও ব্যারিস্টারি—সব ক্ষেত্রেই প্রস্তুত হতে পারি।”

ভূমি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল গড়ে তোলা : দেশে জমি সংক্রান্ত বিবাদের কারণে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। ভূমি রেকর্ড, খতিয়ান, দাগ নম্বর ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান অপ্রতুল। এই প্রেক্ষাপটে পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে—শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ে ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস ও আদালতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর ফলে তারা বাস্তব আইন প্রয়োগের ধারণা লাভ করে, যা কর্মক্ষেত্রে তাদের বাড়তি সুবিধা দেয়।

শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক: এক আন্তরিক পরিবার : এই অনুষদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যেন এক পরিবারের মতো। শিক্ষকরা সব সময় পরামর্শ দেন, গবেষণায় সহায়তা করেন, এবং শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখতে শেখান।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের বিভাগে শুধু পড়াশোনা নয়, নৈতিকতা শেখানো হয়। আমরা শিখি কীভাবে একজন সৎ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : অনুষদটি ভবিষ্যতে একটি ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড অ্যান্ড লিগ্যাল রিসার্চ’ স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে ভূমি সংস্কার, আইনি পুনর্বিবেচনা ও টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হবে।

শেষকথা: ন্যায় ও জ্ঞানের সংমিশ্রণ : পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ আজ কেবল একটি বিভাগ নয়—এটি এক দর্শন, এক প্রতিশ্রুতি। এখানে গড়ে ওঠা প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ন্যায়বিচারের আলো নিয়ে সমাজে ফিরে যায়—এটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যাশা। ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করতে চাই, যারা আইন জানবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জানবে ন্যায় কী, সত্য কী। আইনশিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো মানুষকে মানুষ বানানো। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করুক তা নয়—তারা যেন নীতি ও মূল্যবোধের দিক থেকেও উৎকর্ষতা অর্জন করে। এজন্য গবেষণা ও নৈতিক শিক্ষার ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ: ন্যায়ের পথে আলোর কারিগর

প্রকাশিত : ০৯:৩৩:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ নভেম্বর ২০২৫

জুবাইয়া বিন্তে কবির:

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল—সমুদ্র ও সবুজে ঘেরা পটুয়াখালী, যার বুক চিরে উঠেছে এক অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি)। প্রযুক্তি, কৃষি, মৎস্য, ব্যবসা প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি—সব অনুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে যেভাবে বিকশিত হয়েছে আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, তা আজ দেশের উচ্চশিক্ষায় এক উজ্জ্বল সংযোজন।

আইনশিক্ষা: মানবতার পথে এক অনন্ত যাত্রা: সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে মানুষ ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত। সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং মানবিক মূল্যবোধকে লালন করতে আইনই মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়া মানে শুধু পেশার প্রস্তুতি নয়—এটি এক নৈতিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রা। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ এই মানবিক বোধকে বাস্তবতার মাটিতে রোপণ করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল সংবিধান, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন শেখে না; শেখে কীভাবে আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।

ভূমি প্রশাসন: সময়ের দাবি : বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ভূমির সঙ্গে। কিন্তু এই ভূমিই আজ অনেক সময় হয়ে ওঠে বিবাদের কারণ—মামলার বোঝা, দখল, জাল দলিল, বা সীমারেখা নিয়ে অনন্ত দ্বন্দ্ব। এই প্রেক্ষাপটে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইনি জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। দেশে এখন প্রায় ৭০ শতাংশ মামলাই ভূমি-সংক্রান্ত। তাই ভূমি আইন জানা একজন আইনি পেশাজীবীর জন্য অপরিহার্য দক্ষতা। এখানেই পবিপ্রবির এই অনুষদ সময়ের চাহিদা মেটাতে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে।

অনুষদটির ডিনের দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর মো. জামাল হোসেন এবং অনুষদে কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোঃ সাইদুর রহমান জুয়েল। ডিন প্রফেসর মো. জামাল হোসেন বলেন, “আমাদের লক্ষ্য কেবল পেশাদার আইনবিদ তৈরি করা নয়; এমন নাগরিক তৈরি করা যারা মানবতার সেবা করবে। শিক্ষার্থীরা যেন আইনের নৈতিক দিকটি অনুধাবন করতে পারে, সেটিই আমরা গুরুত্ব দিই।”

শিক্ষকবৃন্দ: জ্ঞানের আলোকবর্তিকা : এই অনুষদের শিক্ষকেরা শুধু একাডেমিক নয়, সমাজ সচেতন গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পথ দেখান। এই অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. আব্দুর রহিম, এছাড়াও রয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক মো. রেজাউল ইসলাম মাসুম, সহকারী অধ্যাপক মো. রহমত সরকার, সউদ বিন আলম প্রতীক এবং প্রভাষক পদে রয়েছেন আমিনা সারওয়ার—তাঁরা আইনের জটিল ধারণাকে সহজভাবে উপস্থাপন করেন।

সহযোগী অধ্যাপক মো. মাসুম বিল্লাহ এবং সহকারী অধ্যাপক মোঃ সউদ বিন আলম প্রতিক বলেন, “ভূমি প্রশাসন বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বহুমাত্রিক দিগন্ত খুলে দেয়। তারা আদালত, প্রশাসন, কর্পোরেট ক্ষেত্র, এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও কাজ করতে সক্ষম হয়। এবং আমাদের পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে তত্ত্ব ও প্রয়োগ—দুটিই সমান গুরুত্ব পায়। শিক্ষার্থীরা মাঠপর্যায়ে ভূমি প্রশাসনের বাস্তব কার্যক্রম বুঝতে পারে, আবার আদালতের কাঠামোতেও দক্ষ হয়ে ওঠে।”

পবিপ্রবির সম্মানিত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. ইকতিয়ার উদ্দিন বলেন, “এই অনুষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষতার নতুন উদাহরণ। আইনশিক্ষা মানে কেবল তত্ত্ব নয়—এটি নেতৃত্ব, দায়িত্ব ও নৈতিকতার শিক্ষা। পবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা এখন শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ আইনবিদ হিসেবে নিজেদের তৈরি করছে।” তিনি আরও বলেন, “ভূমি প্রশাসন ও আইন একত্রে শেখানো হচ্ছে বলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের নীতি-নির্ধারণ, সরকারি প্রশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।”

কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবদুল লতিফ বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নির্ভর করে জ্ঞানের বৈচিত্র্যের উপর। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ শিক্ষায় বৈচিত্র্য এনেছে। এখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞান ও আইনের মেলবন্ধন ঘটেছে—যা শিক্ষার্থীদের সমন্বিত চিন্তাশক্তি গড়ে তোলে।” তিনি আরও বলেন, “এই অনুষদ দেশের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থায় যে দক্ষ জনবল তৈরি করছে, তা একদিন জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত বলেন, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আইনের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আইনি জ্ঞান, সাইবার আইন, ডেটা প্রাইভেসি ও অনলাইন বিচারব্যবস্থার বিষয়ে ধারণা দিচ্ছে। এটি ভবিষ্যতের আইন শিক্ষার দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদ সময়ের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে চলছে। আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ সেই ধারাবাহিকতার এক অসাধারণ উদাহরণ।”

ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু ডিগ্রির কারখানা নয়; এটি চিন্তার কারখানা। আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ সেই চিন্তারই প্রতিফলন। এখানে আমরা এমন আইনবিদ তৈরি করছি, যারা ন্যায়বিচারের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে।” তিনি আরও বলেন, “ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম বাধা। তাই এই অনুষদ শুধু শিক্ষায় নয়, জাতির উন্নয়ন কাঠামোতেও অবদান রাখছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—পবিপ্রবি থেকে একদিন বের হবে এমন এক প্রজন্ম, যারা ন্যায়, সত্য ও দায়িত্ববোধে বিশ্বকে বদলে দেবে।”

গবেষণা ও আধুনিক পাঠক্রম : পবিপ্রবির এই অনুষদে শিক্ষার্থীরা শুধু বইয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। তারা অংশ নেয় মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা, লিগ্যাল ক্লিনিক, এবং রিসার্চ কনফারেন্সে। এখানে তৈরি হয় বিচারিক ভাষার দক্ষতা, বিশ্লেষণক্ষমতা, এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। আইন ও ভূমি প্রশাসনের সমন্বিত পাঠ্যক্রমে যুক্ত রয়েছে—

ভূমি জরিপ, রিয়েল প্রোপার্টি ল, এনভায়রনমেন্টাল ল, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস এবং সাইবার ল’-এর মতো আধুনিক কোর্স। ক্যারিয়ার সম্ভাবনা: বিস্তৃত দিগন্ত পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের শিক্ষার্থীরা দেশের ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তারা সুযোগ পাচ্ছে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে, প্রশাসন ক্যাডারে, কর্পোরেট ল’ ফার্মে, লিগ্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়। শিক্ষার্থী মায়মুনা জায়রা বলেন, “আমাদের কোর্স এমনভাবে সাজানো যে, আমরা একসঙ্গে বিসিএস, বিজেএস ও ব্যারিস্টারি—সব ক্ষেত্রেই প্রস্তুত হতে পারি।”

ভূমি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল গড়ে তোলা : দেশে জমি সংক্রান্ত বিবাদের কারণে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। ভূমি রেকর্ড, খতিয়ান, দাগ নম্বর ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান অপ্রতুল। এই প্রেক্ষাপটে পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে—শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ে ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস ও আদালতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর ফলে তারা বাস্তব আইন প্রয়োগের ধারণা লাভ করে, যা কর্মক্ষেত্রে তাদের বাড়তি সুবিধা দেয়।

শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক: এক আন্তরিক পরিবার : এই অনুষদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যেন এক পরিবারের মতো। শিক্ষকরা সব সময় পরামর্শ দেন, গবেষণায় সহায়তা করেন, এবং শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখতে শেখান।
একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের বিভাগে শুধু পড়াশোনা নয়, নৈতিকতা শেখানো হয়। আমরা শিখি কীভাবে একজন সৎ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : অনুষদটি ভবিষ্যতে একটি ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড অ্যান্ড লিগ্যাল রিসার্চ’ স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে ভূমি সংস্কার, আইনি পুনর্বিবেচনা ও টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হবে।

শেষকথা: ন্যায় ও জ্ঞানের সংমিশ্রণ : পবিপ্রবির আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ আজ কেবল একটি বিভাগ নয়—এটি এক দর্শন, এক প্রতিশ্রুতি। এখানে গড়ে ওঠা প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ন্যায়বিচারের আলো নিয়ে সমাজে ফিরে যায়—এটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যাশা। ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করতে চাই, যারা আইন জানবে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জানবে ন্যায় কী, সত্য কী। আইনশিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো মানুষকে মানুষ বানানো। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করুক তা নয়—তারা যেন নীতি ও মূল্যবোধের দিক থেকেও উৎকর্ষতা অর্জন করে। এজন্য গবেষণা ও নৈতিক শিক্ষার ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।