জুবাইয়া বিন্তে কবির:
ঢাকার ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে গেলে একসময় আমরা দেখতে পাই, এই শহরের শ্বাস-প্রশ্বাস এক নদীর সাথে মিশে ছিল—বুড়িগঙ্গা। সেই নদী ছিল প্রাণের উৎস, সৌন্দর্যের আঁধার এবং মানুষের জীবনের স্বাভাবিক চলাচলের একমাত্র ভরসা। কিন্তু আজ, ঢাকা যেন এক খাঁচার ভেতর বন্দি শ্বাসরুদ্ধ মানুষদের শহর। যে শহর একদিন সবুজে ঢাকা, নদীর স্রোতের মায়ায় মাতোয়ারা ছিল, আজ তা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিলীন হতে বসেছে।
এক সময়ের ঢাকা: নবাবের শহর, নদীর শহর:- কল্পনায় ফিরে যাই নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুরের সেই সময়ের ঢাকায়। শহরটি তখন ছোট হলেও প্রাণবন্ত ছিল। নদীর টলমলে জলে প্রতিফলিত হতো রঙিন পালতোলা নৌকার সারি। নবাবের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছিল এক অপরূপ সৌন্দর্যের রাজ্য। ফুলের সুবাসে ভরে যেত বাতাস, ফলের বাগানে শোনা যেত পাখির কলরব। নদীর তীরে বসে নবাব ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনকে প্রশান্ত করতেন। জেলের নৌকা থেকে তাজা রুই আর ইলিশের গন্ধ ভেসে আসত নবাবের ভোজের জন্য। শহর তখন জীবনের প্রতীক ছিল, আনন্দের প্রতীক ছিল। কিন্তু আজ? নদীটি শুধু ইতিহাসের পাতায় আছে। বাস্তবে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত, প্রাণবায়ু বন্ধ। যে নদী শহরকে জন্ম দিয়েছিল, সেই নদীকেই আমরা সময়ের নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছি।
আজকের ঢাকা: এক মৃতপ্রায় খাঁচা: শহর বলতে এখন কী বুঝি আমরা? গাড়ির কালো ধোঁয়ায় ভরা বাতাস।
নর্দমার দুর্গন্ধে দূষিত নদী। কংক্রিটের খাঁচার ভেতরে শ্বাসরুদ্ধ প্রাণ। খেলাধুলার মাঠের জায়গায় বহুতল ভবন।
পুকুরের জলের ওপর গড়ে তোলা কঙ্কাল শহর। এখন ঢাকা শুধু এক অদৃশ্য কারাগার। যেখানে মানুষ শুধু মানুষকে ধাক্কা মারে, কিন্তু প্রকৃতির সাথে এক বিন্দু মিলন নেই। নীলক্ষেতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে যে সময় লাগার কথা দুই মিনিট, সেখানে লেগে যায় বিশ মিনিট। বায়ুদূষণে পৃথিবীর তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে ঢাকা। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন বিষের মতো ফুসফুসে জমা হয়। অথচ এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমরা এমন এক শহরে বাস করছি যেখানে না আছে সবুজের গন্ধ, না আছে খেলার মাঠ, না আছে খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নেওয়ার মুক্তি। শুধু আছে মানবদেহের অপরিকল্পিত স্তূপ আর এক অন্তহীন বিশৃঙ্খলা।
বুড়িগঙ্গার মৃত্যু মানেই ঢাকার মৃত্যু:- পৃথিবীর সব ঐতিহাসিক শহরের প্রাণ ছিল নদী। লন্ডনের টেমস, প্যারিসের সেইন, কায়রোর নীল। আমাদের ঢাকা জন্মেছিল বুড়িগঙ্গার কোলে। অথচ সেই নদীর বুকেই আমরা ঢেলে দিয়েছি শহরের সমস্ত বর্জ্য, সমস্ত বিষ। নদী এখন মৃতপ্রায়। তার জলে নেই স্বচ্ছতা, নেই প্রাণের স্রোত। বুড়িগঙ্গার মৃত্যু মানে ঢাকার প্রাণের মৃত্যু। আমরা নদীকে হত্যা করেছি, তাই শহরও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। যে শহর একদিন পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ শহরের তালিকায় ছিল, আজ তা কেবল নেতিবাচকতার শীর্ষে।
আমার বয়ক্তিগত জীবনে ঢাকার দিনগুলো: স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সম্ভাবনার গল্প:- বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গে এই শহরের বন্ধন যেন অটুট। এই শহরের ধুলোমাখা পথচলা, যানজটের ভিড়, ভাঙা ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া কিংবা রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া—এসবই ঢাকাকে দিয়েছে অন্যরকম এক প্রাণ।
আমি, জুবাইয়া বিন্তে কবির, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আজও আমার মনের গহীনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সকালে ক্লাস, দুপুরে লাইব্রেরির নীরবতা, বিকেলে টিএসসির উচ্ছ্বাস আর রাতে ক্যাম্পাসের শান্ত প্রহর—সব মিলিয়ে সেই দিনগুলো যেন এক স্বপ্নের মতো ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা দেয়নি, শিখিয়েছে জীবনের প্রতিটি মূহূর্তকে মূল্য দিতে। সংগ্রামের পথ দেখিয়েছে, স্বপ্নের ডানায় উড়তে শিখিয়েছে। তখনকার ঢাকাকে আমি ভালোবেসেছি—অগোছালো হলেও প্রাণবন্ত, ব্যস্ত হলেও সম্ভাবনায় ভরপুর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঢাকা যেন এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আজকের ঢাকার দিকে তাকালে মাঝে মাঝে শ্বাসরুদ্ধকর এক হতাশা এসে ভর করে।
বরিশাল: প্রশান্তির শহরে নতুন জীবনের ঠিকানা:- পড়াশোনা শেষে জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলাম—বিবাহিত জীবন। স্বামী, সন্তান এবং শাশুড়ীকে নিয়ে বর্তমানে আমি বরিশালে বসবাস করছি। এ শহর যেন এক স্বস্তির ঠিকানা। এখানকার পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী আর সবুজের সমারোহ আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। বরিশালের সকালগুলো ঢাকার মতো ধোঁয়া আর গাড়ির হর্নে ভরা নয়। এখানে নদীর বুক চিরে ঠাণ্ডা বাতাস আসে, রাস্তার দু’পাশে সাজানো থাকে শিউলি আর কাশফুলের হাসি। শহরের ব্যস্ততাও আছে, কিন্তু সেটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে মিশে আছে শান্তির আবহে। এখানে আমার সন্তান বড় হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে, বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। পরিবার নিয়ে নির্ভয়ে বাইরে হাঁটতে পারি, নদীর পাড়ে বসে গল্প করতে পারি। এমন জীবনযাপনের স্বাদ ঢাকায় থাকা অবস্থায় কখনও পাইনি।
ঢাকার চাকরির সুযোগ বনাম জীবনের মানের হিসাব:-
ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলাম। একাধিক প্রতিষ্ঠান আমাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু শর্ত ছিল—থাকতে হবে ঢাকাতেই।
প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি। চাকরির সুযোগ হয়তো জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান এনে দেবে। কিন্তু এর জন্য কি আবার ফিরতে হবে সেই যানজটের দমবন্ধ শহরে, যেখানে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হবে, যেখানে পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, নিরাপত্তাহীনতা নিত্যসঙ্গী হবে? বরিশালে থাকার মানে শুধু নিজের স্বস্তি নয়, পরিবারের সুখ-শান্তিও নিশ্চিত করা। তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার চাকরির সুযোগগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি। হয়তো অনেকের কাছে এটি পেশাগত জীবনের পিছিয়ে পড়া মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে জীবনের মানই আসল সাফল্য।
ঢাকার বর্তমান চিত্র: স্বপ্নের শহর থেকে দমবন্ধ নগরীতে রূপান্তর:- ঢাকা আজ এক ভিন্ন শহর। অতীতের সরলতা আর প্রাণবন্ত আবহ আজ হারিয়ে গেছে। এখন ঢাকার নাম এলেই মনে আসে যানজটের যন্ত্রণা, ধোঁয়ার কুয়াশা, নদী দখল, ফুটপাথে দখলদারিত্ব, শব্দদূষণ, নোংরা রাজনীতি আর মানুষের অসহায়তার ছবি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকায় বসবাস মানে এক নিরন্তর যুদ্ধ। বাসে বা রিকশায় ওঠার জন্য ঠেলাঠেলি, বাসস্ট্যান্ডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, রাস্তায় গন্তব্যে পৌঁছাতে অযথা সময়ের অপচয়—সবকিছু মিলে ঢাকায় বসবাস যেন এক অদৃশ্য শিকলে বন্দি থাকা। ঢাকার নাগরিকদের অনেকেই স্বপ্ন দেখে অন্য শহরে বা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার। অথচ এই শহরই একসময় স্বপ্ন দেখাত। আজকের বাস্তবতা যেন সেই স্বপ্নকে শ্বাসরোধ করে ফেলেছে।
ঢাকার স্মৃতি: হৃদয়ের এক অমূল্য সম্পদ:- ঢাকা আজ যতই বিশৃঙ্খল হোক না কেন, আমার জীবনের সেরা সময়গুলো কেটেছে এই শহরেই। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমার স্বপ্নের জন্মভূমি। এখানে আমি শিখেছি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেতে, সংগ্রাম করতে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে। টিএসসির চায়ের কাপে রাজনীতি থেকে প্রেম—সবই ছিল আলোচনার বিষয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য স্বপ্ন দেখা, বটতলায় কবিতা পাঠ, নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোরাঘুরি—সবকিছু আজও স্মৃতির অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। যদি কখনও ঢাকায় ফিরে যেতে হয়, হয়তো সেই স্মৃতিগুলোর জন্যই যাবো, আজকের বাস্তবতার জন্য নয়।
ঢাকার জন্য আমার প্রত্যাশা: স্বপ্নের শহর ফিরে পাক শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা:- আমি চাই, ঢাকাকে আবার তার পুরনো সৌন্দর্যে ফিরিয়ে আনা হোক। এ শহরটি যেন শুধু অর্থনীতি বা রাজনীতির কেন্দ্র নয়, মানুষের বসবাসের উপযোগী একটি শহর হয়ে ওঠে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, উন্নত নগর পরিকল্পনা, সুস্থ যানবাহন ব্যবস্থা আর সবুজের সমারোহে ভরা এক ঢাকা—এটাই আমার স্বপ্ন। একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ঢাকাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব যদি আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি। সরকার, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবাই মিলে ঢাকাকে নতুন করে সাজাতে পারি। এই শহরকে শুধু স্মৃতির শহর নয়, বসবাসের উপযোগী শহর বানাতে পারি।
সরকারের প্রতি আবেদন:- মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ—আমরা নাগরিকেরা আপনাদের কাছে একটাই আবেদন রাখছি: দয়া করে আমাদের শহরকে বাঁচান। আজ না করলে কাল হবে না।
ঢাকাকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। নদীগুলোকে ফিরিয়ে না দিলে, সবুজ ফেরাতে না পারলে এই শহর শুধু আরও বড়ো মৃত্যুকূপে পরিণত হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমাদের সবাইকে শহর ত্যাগ করতে হবে। কেন আমরা সেই পরিস্থিতি আসার অপেক্ষা করব? কেন আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য বিষের শহর রেখে যাব? ঢাকাকে বাঁচানোর জন্য যদি পরিকল্পিত পুনর্বাসন, শিল্পের স্থানান্তর, সাময়িক অসুবিধা সহ্য করতেই হয়, তবে সেটাই মেনে নিতে হবে। কারণ এর বাইরে কোনো পথ নেই। একটি সময়ের ঢাকাকে আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই। নবাবের সময়কার সেই নদীর শহর, সেই ফুলের শহর, সেই আনন্দের শহর। চাই শ্বাস নেওয়ার মুক্তি, চাই বুড়িগঙ্গার বুক ভরা স্রোতধারা। ঢাকা যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়। নদী যেন আবার গান গায়। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এটাই আমাদের দাবি।
পরিশেষে, স্মৃতি, স্বপ্ন আর বাস্তবতার টানাপোড়েন:- ঢাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এক প্রেমকাহিনীর মতো। সেখানে ছিল প্রেমের উচ্ছ্বাস, ত্যাগের গল্প আর বিচ্ছেদের বেদনা। আজ আমি বরিশালে থাকি, কিন্তু ঢাকার স্মৃতি এখনও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। আমি চাই না ঢাকা কেবল অতীতের গল্প হয়ে থাকুক। আমি চাই আমার সন্তানও একদিন ঢাকায় গিয়ে শ্বাস নিতে পারুক স্বস্তিতে, দেখতে পারুক এক পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, প্রাণবন্ত ঢাকা। হয়তো তখন আমি আবার বলতে পারবো—হ্যাঁ, এই ঢাকা আমার স্বপ্নের শহর।