রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) সাবেক কমিশনার মুহাম্মদ আবদুল আলীম মাহমুদের প্রভাব খাটিয়ে জমি ও বসতবাড়ি দখলের অভিযোগ উঠেছে। আবদুল আলীমের ভাগনে জামাই তৌহিদুল বাহিনীর নেতৃত্বে এ দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী মশিউর রহমান। তৌহিদুল ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) দুপুর ১২টায় নগরীর সুমি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুক্তভোগী মশিউর রহমান, তার স্ত্রী তাজনীন নাহার, কন্যা মারজিয়া তাবাসসুম ও শাশুড়ি সায়মা আক্তার।

সংবাদ সম্মেলনে মশিউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আমার বাবা মোহাম্মদ আলী ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল ৫৩১০ নং দলিল মূলে ডা. গিয়াস উদ্দিন মিয়ার কাছ থেকে ছয় শতক এবং ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৯১ নং দলিল মূলে একই দাগে সাহেরা বানুর কাছ থেকে ১২ শতক জমি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে আমার পিতা ২০১৪ সালের ১৯ জুন ৯৫৭৭ নং হেবা দলিল মূলে ৬ শতক এবং ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল ৬৩৭৫ নং হেবা দলিল মূলে ১২ শতকসহ মোট ১৮ শতক জমির মালিকানা প্রাপ্ত হই। আমার পিতা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বসতবাড়ি ও দোকানঘর নির্মাণ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছি।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীমের ভাগনে জামাই আকিফুল ইসলাম ওরফে টুটুল (মুহাম্মদ আবদুল আলীমের সম্বন্ধী, ন্যাশনাল ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজার মো. আনোয়ার হোসেনের শ্যালকের জামাই), ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম ও তার বাহিনী ১০০-১৫০ জন সন্ত্রাসী নিয়ে আমার বসতবাড়ি ও দোকানপাট জোরপূর্বক দখল করে পরিবার-পরিজনসহ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। শুধু তাই নয়, ওই সময় আমি কোতোয়ালি থানায় মামলা করলেও তদন্ত কর্মকর্তা, তৎকালীন এসআই এরশাদ আমাকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে সাদা কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেন। এসব বিষয় নিয়ে সেই সময় বিভিন্ন টেলিভিশন এবং অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার হয়।
মশিউর রহমান আরও অভিযোগ করেন, সাবেক পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীম মাহমুদের ভাগনে জামাই আকিফুল আমার বসতবাড়ি ও দোকানপাট পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখল করার পর ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ওই জমি ক্রয় দেখিয়ে একটি ভুয়া দলিল (দলিল নং ২০৬৬৮) তৈরি করেন। বিষয়টি জানতে পেরে আমি যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে ওই ভুয়া দলিল বাতিল চেয়ে মামলা করি। ওই মামলায় আদালত ভুয়া দলিল বাতিল ও জবরদখলকারী আকিফুলকে উচ্ছেদ করতে রায় দেন।

এ সময় মশিউর বলেন, আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পরিবার-পরিজনসহ গত ২ আগস্ট আমার পৈতৃক সম্পত্তিতে বসবাস শুরু করি। কিন্তু আবারও সাবেক পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আবদুল আলীমের ভাগনে জামাই আকিফুল ইসলাম টুটুল তার পুলিশ শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার বসতবাড়ি ও দোকানপাটে সন্ত্রাসী হামলা চালায়।
মশিউর অভিযোগ করেন, ২ আগস্ট যখন তারা আমার বসতবাড়ি দখল করার জন্য আসে, তখন পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দুই পক্ষের কাছ থেকে চাবি নিয়ে রাখে এবং ১৫ আগস্ট এ বিষয়ে বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা জানায়। এরপর এ বিষয়ে আমি একটি অভিযোগও দাখিল করি থানায়। কিন্তু থানার তদন্ত কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান এ বিষয়ে লুকোচুরি খেলতে থাকেন এবং আকিফুল সাবেক পুলিশ কমিশনারের ভাগনে জামাই হওয়ায় তার পক্ষ নিয়ে তাকে চাবিও দেন। আমি যখন সংবাদ সম্মেলন করছি, তখন শুক্রবার (৮ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টায় আকিফুল সন্ত্রাসীদের দিয়ে আবারও আমার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে জানালেও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি এবং তারা নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
মশিউর প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়েও কীভাবে আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের বড় কর্মকর্তার পরিচয়ে দখলদাররা আবারও আমার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা করছে? বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক। তারা আমার পরিবার-পরিজনকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে আমিসহ আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পৈতৃক সম্পত্তি আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের দখল থেকে রক্ষা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আকিফুল ইসলাম ওরফে টুটুল বলেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল আলীম মাহমুদ আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আমি আমার নিজের পরিচয়ে চলি, তাকে ভাঙিয়ে আমি চলি না। ওই জমি আমি নিজের টাকায় ক্রয় করেছি। মশিউর তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ২ আগস্ট আমার জমি, বসতবাড়ি ও দোকানপাটে হামলা চালিয়ে অর্ধকোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। পরে সেনাবাহিনী আমাকে চাবি দিয়েছে। আমি এসআই শাহিনুরকে চিনি না।
এ ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) সাবেক কমিশনার মুহাম্মদ আবদুল আলীম মাহমুদ বলেন, আমি কখনোই কোনো অন্যায় করিনি। অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিইনি। আকিফুলের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে অভিযোগ ওঠার পর তার সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। যদি আকিফুলের বিরুদ্ধে আমাকে জড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করা কিংবা কোনো অন্যায়ের অভিযোগ থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আমি এখন নিজেই ওএসডি। আমি কখনোই প্রভাব বিস্তার করিনি, আইনের বাইরে যাইনি। কাউকে আইনের বাইরে কোনো সুবিধাও দিইনি। আমার নাম যদি কেউ ভাঙায়, তবে তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, ওই জমিটি আওয়ামী লীগের আমলে দখল করা হয়েছিল। আদালতের রায়ে এক মাসের মধ্যে জমিটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আকিফুলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক মাস না যেতেই মশিউর ওই জমিতে উঠে যান। এ নিয়ে হট্টগোল বাঁধলে আমরা সেখানে উপস্থিত হই। পরে সেনাবাহিনী আসে। দুই পক্ষের চাবি নিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সমঝোতা বৈঠকে মশিউর না আসায় আকিফুলকে চাবি দেওয়া হয়েছে। আকিফুল ও মশিউরের করা মামলার আদেশের স্থগিতের আদেশ নিয়ে এসেছে, যার শুনানি হবে ১৬ অক্টোবর।
এই আদেশের বলে দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকলো কীভাবে আকিফুল? এই প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ। কোনোভাবেই এ ধরনের কাজ করা তার ঠিক হয়নি। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী বলেন, পুলিশিং কিংবা কোনো দলের ক্ষমতা ব্যবহার করে জমি দখলসহ কোনো অপরাধের সুযোগ নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে জানানো হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

ডেস্ক রিপোর্ট 























