‘স্কুল ছুটির পর রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে একটি দ্রুতগামী অটোরিকশা ধাক্কা দেয় ছোট্টশিশু দিনাকে। এতে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’ এ বছরের গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। নিহত দারুল জান্নাত দিনা মাহিগঞ্জ এলাকার আমতলা বিদ্যাপীঠ অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
ছোট্ট দিনাকে হারানোর শোক ছয় মাসেও ভুলতে পারেননি বাবা দোলন মিয়া ও মা রুমিনা বেগম। তাদের অভিযোগ, স্বল্প শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের হাতে এসব যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, ঘটছে প্রাণহানিও। যাত্রীদের সময় বাঁচানোর তাড়ায় তারা দ্রুতগতির এ বাহন ব্যবহার করলেও, বিপরীতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ছত্রিশ বছর বয়সী দোলন মিয়া পেশায় নিজেও থ্রি-হুইলার সিএনজি চালক। প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর সড়কে তুলেছিলেন তার জীবিকার বাহন। সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করায় এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি তিনি। দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় মেয়েকে হারিয়ে তার মধ্যে আরও বেশি সচেতনতা বোধ জাগ্রত হয়েছে।
দোলন মিয়া জানান, তার মেয়ে দিনা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মারা গেছেন। অটোচালক ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। অন্যের অটোরিকশা নিয়ে সেদিন সড়কে যাত্রী নিয়ে দ্রুত ছুটতে গিয়ে এই দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এমন অনেক অদক্ষ, অনভিজ্ঞ, অপ্রশিক্ষিত অটোচালকদের কারণে প্রতিদিনই কোথাও কোথাও ছোট-বড় নানান রকম দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
দিনার মৃত্যুই শেষ নয়, এমন অসংখ্য দুর্ঘটনায় বেড়েছে মৃত্যুর হার ও পঙ্গুত্ব। গত কয়েক বছরে রংপুরে আঞ্চলিক সড়ক ও মহাসড়কে ব্যাপকহারে ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জার রিকশার দাপট বেড়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা শহরে অদক্ষ চালকের কারণে যত্রতত্র বেড়েছে ব্যাপক যানজট। যা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। বেড়েছে বিদ্যুতের ওপর চাপ। এসব যানবাহন ঘিরে সংঘটিত হচ্ছে নানান অপরাধ। শান্তির শহরগুলোতে এখন যেন অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত এসব বাহন।

বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল
রংপুর অঞ্চলের মহাসড়কগুলোতে দিন দিন বেড়ে চলেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও চার্জাররিকশার দৌরাত্ম্য। আইন অনুযায়ী এসব যানবাহনের মহাসড়কে চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে চলছে উল্টো চিত্র। ফলাফল প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে চলাচল করছেন হাজারো যাত্রী, ঘটছে দুর্ঘটনা, হারাচ্ছে প্রাণ।
২০২৪ সালে সারাদেশে অন্তত ১ হাজার ২৪৮টি থ্রি হুইলার দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় ৬৯৬ জন, যা মোট মৃত্যুর ৮ দশমিক চার শতাংশ।
অন্যদিকে ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই সারাদেশে ঘটে ৫৮৭টি দুর্ঘটনা, নিহত ৬০৪ জন। এর মধ্যে থ্রি হুইলার জড়িত ছিল অন্তত ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনা। নিহতদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ যাত্রীই ছিল এসব অটোরিকশার আরোহী।
রংপুরে এর করুণ উদাহরণও আছে। কিছুদিন আগে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে একসাথে ৫ জন নিহত হন রংপুরের মহাসড়কে। রংপুরের সাতমাথায় গত ৩১ জানুয়ারি যাত্রীবাহী বাস ও থ্রি হুইলারের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হন। গত ছয় মাসে রংপুরের মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অর্ধশতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
সড়ক-মহাসড়কে বিপদজনক অটোরিকশা
হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে রংপুর অঞ্চলের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৯৫টি দুর্ঘটনায় ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শারীরিকভাবে অনেকই ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করলেও এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থায়।
এদিকে, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই মাসে সারা দেশে মোট ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮০ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫৪২ জন। এরমধ্যে শুধুমাত্র অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশের পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার ও অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত হন।
অন্যদিকে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, এ বছরের জুলাইয়ে সারা দেশে ৪৪৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৮৫৬ জন। নিহত হয়েছেন ১০৯ জন, যা মোট নিহতের ২৬.০৮ শতাংশ। এরমধ্যে থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ১০৮ জন নিহত হয়েছে।
অটোরিকশার নগরী রংপুর, যানজটে চরম দুর্ভোগ
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন রংপুর। ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বিশাল এই নগরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সড়কই এখন ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশার দখলে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব বাহনের অবাধ বিচরণে অনেকটাই বেসামাল পুরো নগরী। সড়কে বের হলে একাধিকবার পড়তে হয় ট্রাফিক সিগন্যালের মুখে। পুরো নগরের যত্রতত্র পার্কি, যাত্রী উঠা-নামা ও বৈধ অবৈধ রিকশা স্ট্যান্ডের কারণে জনদুর্ভোগের সঙ্গে বেড়েছে যানজট।

রংপুর বিভাগীয় নগর হওয়ায় প্রতিদিন আশপাশের জেলা থেকে লাখো মানুষের আনাগোনায় এই দুর্ভোগ বেড়েছে বহুমাত্রায়। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, অবৈধ এসব বাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশায় ঠাসা। যাত্রী দেখলেই চালকরা যেখানে-সেখানে রিকশা অথবা অটোরিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীর আশায় অটোরিকশাগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। থেমে থেমে কোথাও অটোরিকশার জটলা তৈরি হয় আবার কোথাও দীর্ঘ সারি হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সারির কারণে পথচারীদের সড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে চলাচল করাও বেশ কষ্টকর।
দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বিপজ্জনক এসব হালকা যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও বাস্তবে চিত্র উল্টো। ট্রাফিক আইন অমান্য করে এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এসব অটো ও চার্জাররিকশা যাত্রীদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
সড়কের ‘রাজা’ নিবন্ধনহীন অটোরিকশা, চলছে লাখের অধিক
রংপুর মহানগরসহ জেলার আট উপজেলায় বৈধ-অবৈধ মিলে এক লাখের অধিক ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা চলাচল করছে। এরমধ্যে শুধু রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই রয়েছে অন্তত ৪০ হাজার। পরিস্থিতি এমন, যেন সড়কের ‘রাজা’ নিবন্ধনহীন এসব যানবাহন। অথচ সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স শাখার তথ্য অনুযায়ী, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ৫ হাজার ৩৪১টি এবং চার্জাররিকশা ৫ হাজার ৮০০টি নিবন্ধিত। একেকটি অটোরিকশার লাইসেন্স পেতে সিটি কর্পোরেশনে জমা দিতে হয় ১৭ হাজার ৭০০ এবং চার্জাররিকশা ও ভ্যানের জন্য ৩ হাজার ৩০০ টাকা।
কর্তৃপক্ষের দাবি, কয়েকবছর ধরে সিটি কর্পোরেশন থেকে নতুন করে এসব বাহনের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এখন শুধু নবায়ন করা হচ্ছে। তবে বাইরে অন্য কারও কাছ থেকে একেকটি অটোরিকশার পুরোনো লাইসেন্স হাত-বদলে গুনতে হচ্ছে লাখ টাকা।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মিজু বলেন, অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স ইস্যু হয়নি। বিগত সময়ের দেওয়া লাইসেন্সই বহাল রয়েছে। এখন শুধু নবায়ন করার সুযোগ রয়েছে। যারা নবায়ন করছে না এবং অবৈধ ও অনিবন্ধিত অটো, রিকশা ও ভ্যান ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, ২০০৬-০৭ সালের দিকে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম চীন থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক আমদানি করে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। সরকারি এই সংস্থাটি বলছে, এগুলোর ডিজাইন এবং ফিটনেস পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় নিবন্ধন ও রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। একটু ঝাঁকুনি লাগলেই উল্টে যায়।
তবে পরবর্তীতে আমদানিকারকরা এগুলো আমদানি চালিয়ে যান এবং গ্রামাঞ্চলে বিক্রি শুরু করেন। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি নিয়ে এগুলো স্থানীয়ভাবে চলাচল করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এর সংখ্যা রংপুরসহ সারা দেশে ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে।

বেড়েছে দাম, কমেছে মান
বর্তমানে বেশিরভাগ অটো ও চার্জাররিকশা দেশেই সংযোজিত হচ্ছে। শুধুমাত্র চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ব্যাটারি, মোটর, কন্ট্রলার, চার্জারসহ বিভিন্ন পার্টস দিয়ে শুধু ফিটিং হয়।
ব্যবসায়ী ও চালকরা বলছেন, দেড় দশক আগেও ব্যাটারিচালিত যেসব অটোরিকশা ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় পাওয়া যেত। এখন তা বেড়ে ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে ব্যাটারি ভেদে দামে কিছুটা হেরফের রয়েছে। আর চার্জাররিকশা এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায়। তবে আগের মতো এখন এসব বাহনের মান নিয়ে নেই সন্তুষ্টি। বরং দেশীয় সংমিশ্রণ আর মানহীন যন্ত্রাংশের সংযোজন এবং ব্যাটারির কারিশমায় অটো ও চার্জাররিকশা কিনে কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছেন।
রংপুর নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার শাপলা ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী রাশেদুজ্জামান রাশেদ বলেন, আগের তুলনায় এখন ব্যাটারিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের দাম অনেক বেশি। এ কারণে আমদানিকারকরা এসব বাহনের দাম বাড়িয়েছে। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত একটি চার্জাররিকশা সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা। মিশুক রিকশার সিট ক্যাপাসিটি ভেদে একেকটি রিকশার দাম ১ লাখ ১৮ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া ব্যাটারিচালিক বোরাক অটোরিকশা এখন আড়াই লাখ থেকে দুই লাখ পয়ষট্টি হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা কিস্তি সুবিধায় কিনলে দাম একটু বেশি হয়ে থাকে।
কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও ভারী শিল্প-কলকারখানার সম্প্রসারণ বঞ্চিত রংপুর অঞ্চলে বেকার সমস্যা দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে তিন চাকার এই বাহনের। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এর দাম বাড়লেও বাড়েনি ব্যাটারিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের মান। যাত্রী ও চালকসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব ব্যাটারির ব্যবহার না থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সবাই। তবে আগের চেয়ে যাত্রী পরিবহনে বেড়েছে ভাড়া। সঙ্গে আয়ের জন্য নির্ভরতাও বেড়েছে এসব বাহনের প্রতি।
নগরীর এরশাদ মোড় ব্রিজ এলাকায় কথা হয় অটোরিকশাচালক বকুল মিয়ার সাথে। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে। রংপুর নগরীর নূরপুর এলাকায় পরিবারসহ ভাড়া থাকেন। তিনি ভাড়ায়চালিত অটোরিকশা নিয়ে প্রতিদিন নগরীর সড়ক থেকে অলিগলি ছুটে বেড়ান। কিন্তু তার সঙ্গে নেই বৈধ কাগজপত্র।
এই অটোচালক বলেন, রংপুর শহরোত ভালোয় কামাই (উপার্জন) হয়। কিন্তুক একবার জ্যামোত (যানজট) পড়লে খুব সময় নষ্ট হয়। এ জ্যামের (যানজট) কারণে কোনো কোনো সময় কামাই (আয়) কম হয়। তার মতো শত শত ব্যাটারিচালিত অটোও চার্জাররিকশার চালক এই নগরীতে আছে, যারা একটু বাড়তি আয়ের আশায় গ্রাম থেকে রংপুরে এসেছেন বলেও তিনি জানান।
ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা বন্ধ করে দেওয়া হলে অসংখ্য মানুষ কাজ হারাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতা ও সংগঠক মাহাবুবার রহমান বেলাল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, রংপুরের মতো জায়গায় অটোরিকশা বেকার যুবসমাজের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এখন সড়ক-মহাসড়কে এর দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এসব যানবাহনের চলাচল বন্ধ না করে নিয়ন্ত্রণে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নিতে হবে। যদি চলাচল বন্ধ করা হয় তাহলে সারা দেশে ছিনতাই, চুরি, রাহাজানিসহ খারাপ কাজ বাড়বে; অটোরিকশার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।

অভিযান-জরিমানাতেও নেই সুফল
রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অভিযান চালানো হলেও প্রভাবশালী মহলের কারণে অনিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি যাত্রীদের চাহিদাও এদের টিকিয়ে রাখছে। হাজারো পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস এসব বাহন। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ যানজট নিরসনে নিয়মিত অভিযানে জব্দ ও জরিমানা করা হয়ে থাকে।
বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) শফিকুল আলম সরকার বলেন, যানজট সৃষ্টির মূল কারণ অটোরিকশা। চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তারা জানে না কীভাবে অটোরিকশা চালাতে হবে। ব্যাটারিচালিত তিন চাকার বাহনগুলো কমপক্ষে শতকরা ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. শরীফুল আলম বলেন, নিয়মিত অভিযান ও জরিমানা করেও অনিবন্ধিত যানবাহনের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। প্রতি মাসেই কম-বেশি অভিযান চলছে। নগরীতে বিকল্প সড়ক ব্যবস্থা না থাকায় যানজটের চাপে আমাদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও চেষ্টা করছে। কিন্তু শুধু আইন প্রয়োগ করে তো এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা, সহযোগিতা, সচেতনতা এবং পরিকল্পিত নগরায়নের আকাঙ্খা থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সারা দেশেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করা দরকার বলে মনে করেন সচেতন মহল। তবে অটোচালকরা বলছেন, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ এগুলো বন্ধ করে দিলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে অপরাধ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কিছু দুর্বলতার সুযোগ দ্রুতগতির ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন দিন দিন সড়কে বেড়ে চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন প্রাণহানি প্রমাণ করছে, প্রশাসনিক শিথিলতা ও সামাজিক উদাসীনতা মিলে এটি একটি জাতীয় সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। রংপুর এখন এই সমস্যার প্রতিচ্ছবি, যেখানে সহজলভ্যতা আর অর্থনৈতিক প্রয়োজনের আড়ালে প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম রংপুরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম পিয়াল বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত, তবে এর মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারির সিসা ও এসিড পরিবেশের জন্য হুমকি হতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলায় উন্নত মানের ব্যাটারি ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি। যেটা রংপুরে দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, এসব অবৈধ যানবাহনের সড়কে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করাসহ আলাদা লেন করে অটোরিকশা চালকদের একটা সিস্টেমে আনাটা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিশেষ করে দুর্ঘটনা রোধ, যানজট নিরসন, বেকারত্ব দূরীকরণে অটোনির্ভর কর্মসংস্থান স্বাভাবিক রাখাসহ পরিবেশের বিপর্যয় এড়াতে পরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে স্থানীয় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে যদি বুয়েটের উদ্ভাবিত অটোরিকশা পর্যায়ক্রমে রংপুরের মতো মফস্বল শহরগুলোতে সরবরাহ করা যায়, তাহলে ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ অটোরিকশার দৌরাত্ম কমে আসবে বলেও মনে করেন এই সংগঠক।
অটোরিকশায় প্রতিমাসে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ
রংপুরে ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা প্রতিদিন তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অটোচার্জে। চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় অটোরিকশা চার্জ অনেকটা মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বিদ্যু নিয়ে বাড়ছে ভোগান্তি।
জানা গেছে, পাঁচ ব্যাটারি সংযুক্ত একেকটি অটোরিকশা চার্জ দিতে প্রতিদিন ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সেই হিসাবে এসব আটো চার্জ দিতে ২৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অটোরিকশা চার্জ দিতে চলে যাচ্ছে। প্রতিমাসে ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পেছনে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগরীর আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক স্পটে ব্যাটারিচালিত চার্জাররকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইকের এসব গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। প্রতিটি গ্যারেজে রয়েছে চার্জ দেওয়ার সুবিধা। চার্জে অনেক বিদ্যুৎ লাগে। গ্যারেজগুলোর বিদ্যুতের সংযোগ বৈধ না অবৈধ, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

নগরীর কোথাও কোথাও গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্টে বাণিজ্যিকভাবে চার্জ দেওয়া হচ্ছে। অনেকের সেটি করার কোনো অনুমতি নেই। অথচ এমন অসংখ্য অবৈধ গ্যারেজ ও চার্জিং পয়েন্ট বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু অটোরিকশা চার্জার মালিক অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে অটোরিকশায় চার্জ দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো এলাকায় আবাসিক লাইন থেকেও চার্জিং পয়েন্টে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়া হয়েছে, যা বিদ্যুৎ আইনের পরিপন্থী। সুষ্ঠু মনিটরিং করলে অবৈধ চার্জ দেওয়া বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন নগরীর সচেতন মহল।
একটি অটোরিকশাচালক আলমগীর হোসেন বলেন, তারা ভাড়ায় রিকশা চালান। দিন শেষে গ্যারেজে ৫৫০ টাকা দেন। চার্জ দেওয়া, রিকশার মেরামত, সবই মালিক দেখেন। গ্যারেজে অনেক লাইন থাকে, কিছু মিটারও দেখেছেন। তবে এগুলো বৈধ না অবৈধ, তা তারা জানেন না।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সব ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট বন্ধ করা হবে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগ। নর্দান ইলেক্টিক সাপ্লাই নেসকো রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, একটি অটোরিকশা চার্জে প্রতিদিন ১০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছে। বিদ্যুতের একটি অংশ অটোরিকশায় চলে যাচ্ছে।
ব্যাটারির সিসা ধ্বংস হয় না থেকে যায় প্রকৃতিতে
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির পুনঃচক্রায়ন প্রক্রিয়া এবং পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেই গবেষণার তথ্য বলছে, ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশা মানুষের অগোচরে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের অকল্পনীয় সর্বনাশ করে যাচ্ছে। খরচ কম, তাই জনগণ ব্যবহার করছে কিন্তু এর ফলাফল কেউ ভাবছে না।
ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সিসা ‘ধ্বংস হয় না’ বরং ‘প্রকৃতিতে থেকে যায়’-এমনটাও বলা হয়েছে গবেষণা থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে। সিসার কারণে মানুষের আইকিউ লেভেল কমে যায়, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সিসা হাইপারটেনশন ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্যও দায়ী।
অটোরিকশাই ভোগান্তির কারণ, সবাই চায় সমাধান
যানজট কমাতে হলে অনিবন্ধিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সুশীল সমাজ। অটোরিকশার চালকেরা যাত্রীদের একরকম জিম্মি করে ফেলছে বলেও অভিযোগ অনেকের। যাত্রীদের অভিমত, মূল সড়কে এসব অটোরিকশার চলাচল নিষিদ্ধ করলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের মাধ্যমেই এসব বাহন পরিচালনার দাবি জানায়।
নগরীর নিসবেতগঞ্জ এলাকার কথা হয় জাহিদ হাসান নামে এর ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ অটোরিকশা চালক এবং বাহনের বৈধ লাইসেন্স নেই। তারা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়, যা দুর্ঘটনার মূল কারণ। ব্যাটারিচালিত অটো ও চার্জাররিকশার যন্ত্রণায় শহরে টেকা মুশকিল। এত বেশি অটো ও রিকশা দেশের অন্য কোনো বিভাগীয় শহরের নেই। অবৈধ এসব যানবাহনের কারণে ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা বাড়ছে।

আমতলা বিদ্যাপীঠ অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বছরের পর বছর এ অবস্থা দেখে আসছি। অটোরিকশা তো কমছে না, বরং বাড়ছে। প্রতিটি মোড়েই স্ট্যান্ড হয়েছে। যেখানে সেখান যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। এসব অটো ও চার্জাররিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে সবাই লোকদেখানো কাজ করেছে। যানজট নিরসনে তেমন কোনো সফল উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিটি বাস সার্ভিস চালু করা হলেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সবাই যেন অটোচালক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি। এভাবে তো চলতে পারে না। সম্প্রতি দ্রুতগতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় আমার প্রতিষ্ঠানের এক শিশুশিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এমন ঘটনা তো প্রায়ই কোথাও কোথাও ঘটছে। অথচ কারও টনক নড়ছে না।
অটোচালক, শ্রমিক, স্থানীয় ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সংগঠকসহ বিভিন্ন পেশার অন্তত ২০ জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের আগেও রংপুরে অটোরিকশার যেমন দাপট ছিল, ৫ আগস্টের পর সেই দাপট ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। ট্রাফিক বিভাগের শিথিল নজরদারির সুযোগে এখন নগরীর অলিগলি থেকে প্রধান সড়কগুলোতেও অটোরিকশার নির্বিঘ্ন চলাচল চোখে পড়ছে। যা নগরবাসীর নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে।
রংপুর জেলা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক সমবায় সমিতির এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অবৈধ অটো ও চার্জাররিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে আমরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন, নিয়মিত অভিযান, জরিমানা ও আলাদা লেন তৈরি করাসহ চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে সিটি কর্পোরেশনকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবনার প্রতি কোনো রকম গুরুত্ব হয়নি।
শ্রমিক নেতার এই অভিযোগের কিছুটা সত্যতা থাকলেও এসব যানবাহনের লাগাম টানতে বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে নানান রকম উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। তবে অটো ও চার্জাররিকশার চালক, শ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীদের নানামুখী চাপ, আন্দোলনের হুমকি, জনপ্রতিনিধিদের ভোটব্যাংক পলিসি এবং কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার অজুহাতে ভেস্তে গেছে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া উদ্যোগ। এ কারণে সচেতন মহল বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের অনীহা ও প্রশাসনের ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’- নীতির কারণে সড়কে অটো ও চার্জাররিকশার একচেটিয়া রাজত্ব এখনো দৃশ্যমান।

ডেস্ক রিপোর্ট 























