জুবাইয়া বিন্তে কবির :
বাংলাদেশের পর্যটনচিত্র আজ একমাত্র সৈকত বা পাহাড় বা শহর কেন্দ্রিক নয় — বরং গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদ-এর সম্ভাবনায় ভরপুর। এই প্রসঙ্গে কুয়াকাটা শুধু একটি সুন্দর সমুদ্রসৈকত নয়; এটি হতে পারে “গ্রামীণ পর্যটনের মডেল” যেখানে কৃষি, মৎস্য, বন, স্থানীয় সংস্কৃতি একসাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছত্রছায়ায়, সাধারণ সাধারণ মানুষের জীবিকার পরিবর্তন, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, দারিদ্র্যহ্রাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ—সবই এক সঙ্গে বাস্তবায়িত হতে পারে।
এর আগে আমাদের পর্যটনমূল্যায়নের কিছু তথ্য জানা জরুরি: দেশের পর্যটন খাত তথ্য অনুযায়ী, Bangladesh Tourism Corporation বলেছে পর্যটন খাত দেশের জিডিপিতে প্রায় ৪ % অবদান রাখছে। একটু আগের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পর্যটন খাত জিডিপির আনুমানিক ৩.০২ % ছিল। অর্থাৎ, পর্যটনের অবদান বাড়ছে, কিন্তু এখনও তার সম্ভাবনায় আমরা পৌঁছায়নি।

গ্রামীণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যটন চর্চা তুলনায় নতুন এবং এখনো অনেক Untapped. এই প্রেক্ষাপটে, কুয়াকাটার সম্ভাবনা এবং সে সম্ভাবনায় দাঁড়িয়ে কার্যকর পরিকল্পনার গুরুত্ব নিয়ে আজ একটু গভীরে ভাবছি।
কুয়াকাটার ভূ-প্রকৃতি ও সামাজিক পরিবেশ
কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত, যেখানে সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে রয়েছে বিশাল সমতল কৃষিভূমি, বনভূমি ও নদীচর। এখানে সাধারণভাবে সাগর ও সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের দৃশ্য বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু শুধু সৈকত নয়, তার আশেপাশের গ্রামীণ জনপদ— ধানক্ষেত, তরমুজ, সূর্যমুখী ফুলের মাঠ, মৎস্যবন্দর, জেলে পল্লী, রাখাইন সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি—all মিলিয়ে রয়েছে রয়েছে এক সুবিশাল সম্ভাবনা। উপকূলীয় জেলেরা দিনরাত সমুদ্রে যেতে থাকেন, কৃষকরা মাঠে পরিশ্রম করেন—এই জীবনের গতিপথ পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হলে তা হয়ে উঠবে এক নতুন অভিজ্ঞতা। স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের হস্তচালিত তাঁতে কাপড় বুনন, বাঁশ-বেত তৈরি, তাদের নাচ-গান ও উৎসব—all পর্যটকদের কাছে এক নিত্যনতুন আকর্ষণ হতে পারে।
গ্রামীণ পর্যটনের আনুষঙ্গিক সম্ভাবনা : এই অঞ্চলে পর্যটনের নিয়ন্ত্রিত ও টেকসই উদ্যোগে নিম্নলিখিত সম্ভাবনা রয়েছে: কৃষিভিত্তিক অভিজ্ঞতা-ভ্রমণ (Agro-Tourism): ধান কাটার সিজনে পর্যটকরা মাঠে যেতে পারেন, কৃষকের সঙ্গে কাজ করতে পারেন, তরমুজ বা সূর্যমুখী ফুলের চাষ দেখতে পারেন—এ ধরনের অভিজ্ঞতা শুধু বিনোদন নয়, শিক্ষণীয় ও স্মরণীয় হয়ে ওঠে।

মৎস্য ও নৌকা-পরিভ্রমণ: জেলেদের সঙ্গে ট্রলারে গিয়ে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা—সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝখানে নৌকায় দাঁড়িয়ে, জাল টেনে মাছ তুলতে পারলে তা হবে এক জীবন-স্মৃতি।
সংস্কৃতি ও হস্তশিল্প পর্যটন: রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনযাপন, তাঁতে কাপড় বুনন, বাঁশ-বেত শিল্প, নাচ-গান—all পর্যটনের সঙ্গে সংযুক্ত করলে থাকে স্থানীয় অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ।
ইকো-ট্যুরিজম ও চর/ম্যানগ্রোভ ভ্রমণ: কুয়াকাটার আশেপাশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, চরাঞ্চল যেখানে নানা জীববৈচিত্র্য দেখা যায়—এগুলোর সংরক্ষণ ও পর্যটনের সঙ্গে সংযুক্ত করা গেলে পরিবেশও রক্ষা পাবে, পর্যটকও আগ্রহী হবে।
উন্নয়নের সম্ভাব্য প্রভাব ও স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান : পর্যটনের মাধ্যমে প্রায়োগিকভাবে স্থানীয় মানুষের আয় বৃদ্ধি পেতে পারে। যেমন: হোমস্টে পরিচালনা, গাইডিং, পরিবহন সেবা, হস্তশিল্প ও খাবার বিক্রয়—সবই নতুন কর্মসংস্থানের উৎস। স্থানীয় নারীরা হস্তশিল্প বা পিঠা-খাবার বিক্রয়ে যুক্ত হতে পারেন, যুবকরা হোমস্টে, পরিবহন বা গাইড হিসেবে কাজ করতে পারেন। কৃষক ও জেলেরা সরাসরি পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন। এইভাবে দারিদ্র্যহ্রাসে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। অর্থনীতিতে এটি নতুন ক্ষেত্রে ভেতর প্রবেশের দরজা খুলতে পারে।
আরও বড় সুযোগ রয়েছে: জাতীয় পর্যায়ে পর্যটন-খাতের অংশীদারিত্ব বাড়লে দেশের অর্থনীতিও আরো শক্তিশালী হবে। (যেমন: ৪ % জিডিপি যুক্ত সম্ভাবনা রয়েছে) উদাহরণস্বরূপ, কুয়াকাটার গ্রামীণ পর্যটন কার্যক্রম চালু হলে নিশ্চিতভাবে ২০-২৫ হাজার কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে—যেমন আপনার প্রবন্ধে আপনি উল্লেখ করেছেন।

বাস্তবমানের চ্যালেঞ্জ ও রূপায়ণের প্রেক্ষাপট :
তবে, শুধু সম্ভাবনা দেখেই হবে না—কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
পরিবেশগত ঝুঁকি: কুয়াকাটাতে পর্যটক আগমন ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় প্লাস্টিক দূষণ, রোদন-চুরান্ত-চরাঞ্চলে ক্ষয়সহ জীববৈচিত্র্যের হ্রাসের হুমকি দেখা দিয়েছে।
অব্যবস্থাপনা: পর্যটন মৌসুমে পর্যাপ্ত আবাসন, খাদ্য, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নেই এমন রিপোর্ট রয়েছে। যোগাযোগ ও অবকাঠামো: যেমন, বিদ্যুৎ সংযোগ ও লোডশেডিংয়ের কারণে হোটেল ও মটেলগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
মৌসুমী হ্রাস: ধরুন, রমজান সময় বা অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পর্যটক হ্রাস পেয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য একাধিক সংস্থা ও স্থানীয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন, যাতে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নও নিশ্চিত হয়।
পরিকল্পনা ও সুপারিশের সুপাঠ — কিভাবে এগোলে হবে? এখন আমরা তাকাই, কুওয়াকাটার এই সম্ভাবনা কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হলে কি করণীয় হতে পারে: পর্যটন-মডেল ডিজাইন করা: সৈকত-ভিত্তিক পর্যটন থেকে গ্রামীণ ও উপকূলীয় পর্যটনের দিকে ধাপবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়া। কৃষি, মৎস্য, বন, সংস্কৃতি—প্রতিটি উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করা। স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: ইউনিয়ন, পাড়া-গ্রামের মানুষ, কৃষক ও জেলে, হস্তশিল্পীরা পর্যটন পরিকল্পনায় অংশ নিবে। তাদের জন্য আয় সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করা হবে।
হোমস্টে ও গাইডিং সেবা বাড়ানো: গ্রামের হোমস্টে, গাইডিং (কৃষি কাজ, জেলে নির্বাহ, রাখাইন নাচ-গান দেখানো) সহ সেবা বিকাশ।
কৃষি এক্সপিরিয়েন্স ট্যুর তৈরি: ধান কাটার সময়, তরমুজ বা ফুলের ক্ষেত পরিদর্শন, কৃষকের সঙ্গে কাজ—এই ধরনের কার্যক্রম পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। মৎস্য বন্দর-নদীভিত্তিক পর্যটন: উপকূলীয় মৎস্যবন্দর, নদীর মোহনায় নৌকা ভ্রমণ, জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা—ব্যতিক্রমধর্মী প্রকল্প। সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ডিং: রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, হস্তশিল্প, উৎসবগুলোকে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করে ‘কুয়াকাটা’কে একটি বিশেষ ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ার উদ্যোগ। পরিবেশ-সুরক্ষা ও টেকসইতা নিশ্চিত করা: বালু ক্ষয়, বন উন্মূলন, প্লাস্টিক দূষণ রোধ, ম্যানগ্রোভ বন সংরক্ষণ—সব পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত।

ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন: যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-জল-এমিটি-স্যানিটেশন, আবাসন উন্নয়ন, পর্যটক-সুবিধা বাড়ানো। মার্কেটিং ও পর্যটক-প্রবাহ আমদানি: শহরের মানুষ, বিদেশি পর্যটক, যুব পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ডিজিটাল মাধ্যম, উৎসব, অ্যাকটিভিটি বৃদ্ধি।
পরিশেষে : গ্রামীণ পর্যটনের এই ধারণাটি শুধু একটি লোভনীয় ভাবনা নয়, বাস্তব সম্ভাবনার প্রতিফলন। কুয়াকাটা—যে শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, বরং তার আশেপাশের গ্রামীণ জীবনের এক বিশাল সম্ভার—ওই ছবিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ক্যানভাস হতে পারে। যদি আমরা সঠিক পরিকল্পনা করি, স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করি, পরিবেশ-সুরক্ষা নিশ্চিত করি এবং টেকসইভাবে গঠন করি তাহলে গ্রামীণ সৌন্দর্যের সঙ্গে পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এখানে শুধুই পর্যটকরা আনন্দ পাবেন না, স্থানীয়রা উন্নত জীবন পাবেন। কৃষক ও জেলে সরাসরি উপকৃত হবেন। নারীরা হস্তশিল্প ও পর্যটন সেবায় যুক্ত হবেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে। সংস্কৃতি সংরক্ষিত হবে। এবং পরিবেশও রক্ষা পাবে।

এই ভাবনা অনুসরণে, কুয়াকাটা হতে পারে দেশের গ্রামীণ পর্যটনের মডেল, যেখানে সমুদ্র, মাঠ, তরী, তাঁতে কাপড় বুনন, জেলে-জীবন—সব এক সঙ্গে মিশে যায়। সাগরের ঢেউয়ের মতো বিস্তৃত হোক কুয়াকাটার স্বপ্ন। টেকসই উন্নয়নের পথে পর্যটন হোক প্রানপ্রবাহ। আমাদের অঙ্গীকার হোক—পর্যটন শুধু বিনোদন নয়, এটি হোক স্থানীয় মানুষ, পরিবেশ ও অর্থনীতির সমৃদ্ধি।

ডেস্ক রিপোর্ট 






















