দেশের পুঁজিবাজারে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নতুন কোনো কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন পায়নি। ফলে দেশের শিল্প খাতে দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাজার থেকে কোনো অর্থায়ন হয়নি। আগের বছরগুলোতে যেসব কোম্পানি ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নিয়েছে তাদের অনেকগুলোই সংগৃহীত তহবিল ব্যবহারে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে গত এক বছরে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ব্যবসায়ীদের অনুকূলে না থাকায় তহবিল ব্যবহারে ধীরগতি তৈরি হয়েছে।
গত ১০ বছরে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে— এমন অন্তত দুই ডজন কোম্পানির আইপিও তহবিল ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে ঢাকা পোস্ট। এতে দেখা গেছে, অনেক কোম্পানি দীর্ঘ সময়েও আইপিও তহবিল ব্যবহার করে শেষ করতে পারেনি। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের তহবিল ব্যবহারের জন্য বারবার সময় বাড়িয়েও বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়নি। বিশেষ করে, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বেশ কয়েকটি কোম্পানি আইপিও তহবিলের এক টাকাও ব্যবহার করতে পারেনি। কয়েকটি কোম্পানি সামান্য পরিসরে ব্যবহার করতে সক্ষম হলেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
কোম্পানিগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তাদের অনেক কিছু হিসাব করতে হচ্ছে। নির্বাচিত নতুন সরকার এলে তারা বিনিয়োগে আসবে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে পুঁজিবাজার থেকে যেসব কোম্পানি অর্থ উত্তোলন করেছে, তার অনেকগুলোই এখন দুর্বল অবস্থানে চলে গেছে। ওই কোম্পানিগুলোকে অর্থ দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভুল ছিল। এখন কোনো কোনো কোম্পানি সেই অর্থ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক কোম্পানিই কোনো ধরনের উদ্দেশ্য ছাড়া আইপিওতে এসেছে। একটা মনগড়া ব্যয় পরিকল্পনা তৈরি করে বিএসইসিতে জমা দিয়েছে। তারা কোথায় অর্থ ব্যয় করবে, অথবা ব্যয় করে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে কি না তা বিশ্লেষণ না করেই টাকা নিয়েছে। প্লেসমেন্টের শেয়ারধারীরা সুবিধা নিতে ওইসব কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে এনেছে। এই কাজগুলো বিগত সরকারের সময়ে বিএসইসির শেষ দুই কমিশনের মেয়াদকালে হয়েছে। যাদের কোনো নির্দিষ্ট ব্যয় পরিকল্পনা নেই, তারা ব্যবহার করতে পারবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিছু কিছু কোম্পানি তো আইপিওর অর্থ নিজেদের মনে করে লুটপাট করে। ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে, যেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোনো অংশীদারিত্ব নেই।’
এক বছরে কোন কোম্পানি আইপিওর কতটা ব্যয় করল
২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইপিওর তহবিল থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে বেস্ট হোল্ডিংস পিএলসি। কোম্পানির ৩৫০ কোটি টাকার তহবিল থেকে ৭৭ কোটি বা ২২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে আলোচিত সময়ে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, যার পরিমাণ ৬৪ কোটি টাকা। বছরের মধ্যে কোম্পানিটি শতকোটির আইপিও তহবিলের ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করেছে।
তবে বড় পরিমাণ অর্থ নেওয়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক গত অর্থবছরে আইপিও তহবিল থেকে মাত্র ৬ কোটি টাকা ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে যা মাত্র ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তারা বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম খুঁজে না পাওয়ায় লক্ষ্য অনুযায়ী আইপিও তহবিলের অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি। বিশেষ করে এসএমই খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর অভাব, পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান অস্থিরতা, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ সংঘাতের কারণে আইপিও থেকে উত্তোলিত অর্থ সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
শুধু গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক নয়, আরও বেশকিছু কোম্পানি গত অর্থবছরে লক্ষ্য অনুযায়ী আইপিও তহবিল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে সিকদার ইন্স্যুরেন্স আলোচিত অর্থবছরে তাদের সংগৃহীত ১৬ কোটি টাকার আইপিও তহবিল থেকে মাত্র ২ কোটি টাকা ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, এই ব্যয় শতকরা হিসাবে তহবিলের মাত্র ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবহার করেছে ৮ কোটি টাকা, যা কোম্পানির সংগৃহীত ৭৫ কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ ছাড়া, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, জেএমআই হসপিটালসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি গত অর্থবছরে আইপিও তহবিলের অর্থ সামান্য পরিসরে ব্যবহার করেছে। তবে এই সময়ের মধ্যে এক টাকাও ব্যবহার করতে পারেনি সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি পেস্টিসাইড এবং আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেড।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং পুঁজিবাজার টাস্কফোর্সের সদস্য আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসছেন না। দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে, এমনটা মনে হয় না। অনেক ব্যবসায়ী নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাজনৈতিক সরকার কী ধরনের ভিশন-মিশন নেয়, সেটা দেখে বিনিয়োগ করবে এমনটা ভাবছেন তারা। ব্যবসায়ীরা চাইলে এখনই বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে, যেসব কোম্পানি বিগত সরকারের সময়ে দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে অর্থ উত্তোলন করেছে, তারাই এখন নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন আইপিও প্রক্রিয়ায় এমন একটা সংস্কারের দিকে যাচ্ছি, যেখানে কেউ ‘দায়সারা’ কাজ করতে পারবে না। সবাইকে একটা জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হচ্ছে। অডিট ফার্মগুলো থেকে শুরু করে ইস্যু ম্যানেজার, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা হচ্ছে। এতে আগামী দিনে যেসব আইপিও আসবে, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা জুগিয়ে কাজ করতে পারবে।’
অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘কিছু কোম্পানি আইপিওর নামে প্রিমিয়ামে শেয়ার ইস্যু করে বাজার থেকে অধিক পরিমাণ অর্থ তুলে নেয়। তারা বাজারে আসে একটা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সান্ত্বনা দেয়। পেছনে লুকানো থাকে অসৎ উদ্দেশ্য। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই জায়গাগুলোতে সংস্কার করতে হবে।’
স্টেকহোল্ডার ও বিএসইসির ভাষ্য
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভালো কোম্পানিগুলোকে আনতে আইপিও প্রক্রিয়া সংস্কারের বিকল্প নেই। আমাদের বাজার যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে আইপিও শূন্য হয়ে আছে, সেহেতু আমরা মনে করি এখন সংস্কার শেষে ভালো কোম্পানিগুলোই আসবে। পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স এটি নিয়ে কাজ করছে। আমরা চাই কোথায় সমস্যাগুলো হচ্ছে তা চিন্থিত করে দ্রুত সমাধান করা হোক।’
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘এখন আর কোনো খারাপ কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসতে দেওয়া হবে না। পাবলিক ইস্যু রুলস ও অন্যান্য বিধানগুলো পরিপালন করে আইপিওতে আসতে হবে। কোনো দুর্বল কোম্পানি আবেদন করলেও সেগুলো অনুমোদন পাবে না। টাস্কফোর্স এটি নিয়ে কাজ করছে। সংস্কারের কাজগুলো হয়ে গেলে বাজারে ভালো কোম্পানিগুলো আসতে শুরু করবে।’