জুবাইয়া বিন্তে কবির: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি পরিচয়ের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। সেসব নাম কেবল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্মরণীয় থাকে না; তারা হয়ে ওঠে একটি জাতির মানসচিত্র, একটি জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংগ্রামের প্রতীক। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান—এই তিনটি নাম ঠিক তেমনই। আমার কাছে, আমার পরিবারের কাছে এবং এ দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষের হৃদয়ের গভীরে এই পরিবার কোনো সাধারণ রাজনৈতিক পরিবার নয়; তারা আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সাহস, আমাদের প্রতিবাদের ইতিহাস। দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রতীক্ষা শেষে ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিছক কোনো ব্যক্তিগত সফর নয়, কোনো দলীয় আনুষ্ঠানিকতাও নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আবেগঘন, গভীর অর্থবহ ও বহুস্তরবিশিষ্ট অধ্যায়। এটি এমন একটি মুহূর্ত, যেখানে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, রাজনৈতিক নির্বাসন, রাষ্ট্রীয় অবহেলা এবং জনগণের অটুট ভালোবাসা—সবকিছু মিলিত হয়ে এক অনন্য ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ তৈরি করেছে।
লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার খবরে সারা দেশের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আবেগের ঢেউ উঠেছে, তা কেবল রাজনৈতিক উচ্ছ্বাস নয়। এটি দীর্ঘদিনের দমবন্ধ করা অপেক্ষার মুক্তি, দীর্ঘ প্রবাসের অবসান এবং একটি নেতৃত্বশূন্যতার অবসান বলে মানুষ বিশ্বাস করছে। যাঁকে ঘিরে এত বছর আন্দোলন, প্রত্যাশা ও প্রতিরোধ—সেই নেতৃত্ব অবশেষে স্বশরীরে দেশের মাটিতে ফিরছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দল শুধু সাংগঠনিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও নতুন শক্তি পাবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর উপস্থিতি ভোটের মাঠে নতুন গতি, নতুন কৌশল এবং নতুন আত্মবিশ্বাস যোগাবে—এমন প্রত্যাশা এখন সর্বত্র।

ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ও অর্জিত নেতৃত্ব : তারেক রহমান জন্মেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবারে। তাঁর পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান—বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের রূপকার এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। তাঁর মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া—স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী, তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতীক। কিন্তু তারেক রহমান কেবল উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনীতিতে আসেননি। তাঁর রাজনৈতিক পথচলা ছিল পরিকল্পিত, ধাপে ধাপে এবং সংগ্রামে পরিপূর্ণ। ১৯৮৯ সালে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সময় তিনি রাজনীতির বাস্তবতা খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি মায়ের পাশে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে তাঁর সাংগঠনিক ভূমিকা আজও রাজনৈতিক মহলে স্বীকৃত। তখন অনেক প্রবীণ রাজনীতিক বলেছিলেন, “তারেক রহমানের মধ্যে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দৃঢ়তার ছায়া স্পষ্ট।” এই উত্থানই তাঁকে একসময় ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনাই হয়ে ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল কারণ।
এক-এগারো, নির্যাতন ও নির্বাসনের নির্মম অধ্যায় : ২০০৭ সালের এক-এগারো পরবর্তী সেনাসমর্থিত সরকারের সময় তারেক রহমানকে একের পর এক রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডের নামে চালানো হয় অকথ্য অমানবিক নির্যাতন। মেরুদণ্ড, পাঁজর ও হাঁটুতে গুরুতর আঘাতে তিনি প্রায় পঙ্গুত্বের পর্যায়ে পৌঁছে যান। এই নির্যাতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটি ভয়াবহ উদাহরণ। একই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে। কোকো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না—তবু প্রতিহিংসাবশত তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতায় কোকোর অকালমৃত্যু জিয়া পরিবারে নেমে আসে গভীর শোক, যা আজও শুকায়নি। ২০০৮ সালে আদালতের নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই যাত্রা কেবল চিকিৎসার ছিল না—তা হয়ে ওঠে জন্মভূমি থেকে এক দীর্ঘ, নীরব ও নির্মম নির্বাসনের শুরু। প্রিয় দেশ, মা, পরিবার, সহযোদ্ধা এবং মানুষের ভালোবাসা পেছনে ফেলে তাঁকে পাড়ি দিতে হয় এক নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে।

প্রবাস থেকেও নেতৃত্ব ও প্রতিরোধ : প্রবাসে থেকেও তারেক রহমান রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তিনি বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। ভার্চুয়াল সভা, ভিডিও কনফারেন্স, সাংগঠনিক নির্দেশনা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব কেবল ভৌগোলিক উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে না। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন, সংগঠন ও প্রতিরোধে তাঁর নেতৃত্ব ছিল নির্ণায়ক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পেছনেও তাঁর কৌশল, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মানবিক রাজনীতির প্রতিচ্ছবি : রাজনীতির বাইরেও তারেক রহমান একজন মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত। অসহায় মানুষের চিকিৎসা সহায়তা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার দায়িত্ব গ্রহণ, শহীদ ও নির্যাতিত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো—এসব কাজ তিনি নীরবে করে এসেছেন। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ তাঁর মানবিক দর্শনের একটি বাস্তব রূপ। তিনি বারবার বলেছেন—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়; মানুষের কল্যাণই রাজনীতির মূল দর্শন।
নিরাপত্তা সংকট ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব : আজ যখন তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন ঘনিয়ে এসেছে, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুলি, সহিংসতা ও ‘হিট লিস্ট’-এর তথ্য আমাদের সবাইকে আতঙ্কিত করেছে।
ইতিহাস সাক্ষী—জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের জীবন সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বেনজির ভুট্টো—এই তালিকা আমাদের নির্মম বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের নিরাপত্তা কোনো আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব। তাঁর প্রতি সামান্যতম আঘাত মানে কেবল একটি দলের ক্ষতি নয়; তা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও গভীর হুমকি।
আবেগ, শৃঙ্খলা ও ভবিষ্যতের পথে : ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের আগমন ঘিরে জনতার আবেগ স্বাভাবিক, এমনকি অনিবার্য। দীর্ঘ দেড় যুগের অপেক্ষা, নিঃশব্দ নির্বাসন, অবদমিত ভালোবাসা ও অপূর্ণতার বেদনা—সবকিছু মিলিয়ে এই আবেগ আজ বাঁধভাঙা নদীর মতো ছুটে আসছে রাজপথে। তবে ইতিহাস আমাদের বারবার সতর্ক করেছে, আবেগ যদি শৃঙ্খলার সীমা অতিক্রম করে, তবে সেই আবেগই একসময় আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে রূপ নিতে পারে। ভালোবাসা প্রকাশের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন তা হয় সংযত, দায়িত্বশীল ও সচেতন। উচ্ছ্বাসের ভিড় নয়, শৃঙ্খলাবদ্ধ উপস্থিতিই পারে একজন নেতাকে প্রকৃত অর্থে সম্মান জানাতে।
দেড় যুগের প্রতীক্ষা শেষে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আশার সূচনা করবে। এটি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরা নয়—এটি ইতিহাসের এক গভীর সন্ধিক্ষণ, যেখানে অতীতের বেদনা, বর্তমানের সংকট এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শুধু একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে—যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার আবারও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসার সুযোগ পাবে।

আমার কাছে, আমার পরিবারের কাছে—শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান কেবল রাজনৈতিক নামমাত্র নন। তাঁরা আমাদের বিশ্বাসের প্রতীক, সংগ্রামের প্রেরণা এবং ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের আস্থার নাম। তাঁদের জীবন কেবল ক্ষমতার গল্প নয়; এটি ত্যাগ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও অবিচলতার এক দীর্ঘ ইতিহাস। এই পরিবার আমাদের শিখিয়েছে—রাজনীতি মানে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা নয়, রাজনীতি মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহস।
আজ যখন তারেক রহমান দীর্ঘ নির্বাসন শেষে মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখতে চলেছেন, তখন আমাদের প্রত্যাশা একটাই—এই প্রত্যাবর্তন যেন কোনো শোকের অধ্যায় রচনা না করে, যেন কোনো অশ্রুর গল্প হয়ে না ওঠে। বরং এটি হয়ে উঠুক আশার দীপশিখা, গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের আলোকবর্তিকা এবং আগামী দিনের পথচলার দিশারি। ইতিহাস যেন একদিন লিখে—এই প্রত্যাবর্তন ছিল বিভাজনের নয়, ঐক্যের; অস্থিরতার নয়, স্থিতির; প্রতিশোধের নয়, পুনর্গঠনের সূচনা। এই মুহূর্তে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সম্মিলিত দায়িত্ব—এই ঐতিহাসিক ক্ষণকে নিরাপদ, শালীন ও মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা। কারণ একটি জাতির ভবিষ্যৎ অনেক সময় একটি দিনের সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। ২৫ ডিসেম্বর তেমনই একটি দিন। লাখো মানুষের হৃদয়ের একক প্রত্যাশা—তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হোক আশার, আলোয় ভরা এবং ইতিহাসের পাতায় গৌরবের অক্ষরে লেখা একটি অধ্যায়।

ডেস্ক রিপোর্ট 





















