ঢাকা ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

বিদায় জুলাই বিপ্লবের অগ্রসেনানী শরীফ ওসমান হাদি একটি নাম, একটি কণ্ঠস্বর, একটি রক্তাক্ত সময়

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ১০:০১:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৫ বার দেখা হয়েছে

জুবাইয়া বিন্তে কবির :   কিছু মৃত্যু আল্লাহ তায়ালার আদালতে সাধারণ মৃত্যু নয়—সেগুলো হয় সাক্ষ্য। সেগুলো হয় সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে রক্ত দিয়ে লেখা জবানবন্দি। কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—

“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের তোমরা মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত, তাদের রবের কাছে রিজিকপ্রাপ্ত।” (সূরা আলে ইমরান: ১৬৯)। শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু তেমনই এক শাহাদাতের ডাক। এটি কোনো সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর প্রস্থান নয়; এটি সত্যের পথে অবিচল এক তরুণের রক্তাক্ত বিদায়, একটি জুলুমবিরোধী কণ্ঠস্বরের দুনিয়াবি নীরবতা, কিন্তু আখিরাতের আদালতে চিরজাগ্রত উপস্থিতি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু মৃত্যু একটি মানুষকে বিদায় দেয় না—সেগুলো একটি জাতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, আমাদের ঈমান, ন্যায়বোধ ও দায়িত্ববোধকে কাঠগড়ায় তোলে। হাদির শাহাদাত ঠিক তেমনই এক মুহূর্ত—যেখানে রাষ্ট্র নয়, সময় নয়; বিচারাধীন হয় আমাদের বিবেক।


মাত্র বত্রিশ বছরের এক তরুণ—যিনি ক্ষমতার দরবারে মাথা নত করেননি, কোনো নিরাপদ ছায়ায় আশ্রয় নেননি—দিনের আলোয়, জনসম্মুখে, গুলিবিদ্ধ হয়ে আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে তাঁর নিঃশ্বাস থামার মুহূর্তে হয়তো তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই জুলাই—রামপুরা, বাড্ডা, শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্য; আর সেই অগণিত মুখ, যারা ভয়কে জয় করে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল।

গুলির শব্দে থমকে যাওয়া একটি সময় : ১২ ডিসেম্বর, দুপুর সোয়া দুইটা। পুরানা পল্টনের বিজয়নগর এলাকা। ব্যস্ত নগরজীবনের মাঝখানে একটি মোটরসাইকেল থামে। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে আসে গুলি। মাথায় বিদ্ধ হয় বুলেট। রিকশায় থাকা তরুণটি লুটিয়ে পড়েন। রক্তে ভিজে যায় রাজধানীর রাজপথ। সেই গুলি কেবল হাদির শরীর ভেদ করেনি—তা আঘাত করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিন। একজন সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী, যিনি কোনো বড় দলের নন, যিনি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বলয়ের বাইরের মানুষ—তাঁকে প্রকাশ্যে হত্যাচেষ্টা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি বার্তা। ভয় দেখানোর বার্তা। জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা—ক্ষমতার বয়ানের বাইরে দাঁড়ালে, এই পরিণতি অপেক্ষা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার, সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর। ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায়—বাংলাদেশ সময়—সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিভে যায় জুলাইয়ের এক প্রদীপ।

জুলাই অভ্যুত্থান: যেখানে হাদি হয়ে উঠলেন কণ্ঠস্বর :
২০২৪ সালের জুলাই—এই মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল একটি ক্যালেন্ডার নয়, এটি এক ধরনের জাগরণ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র–জনতার প্রতিরোধ, আর সেই প্রতিরোধের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু নির্ভীক মুখ। শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন তাঁদের একজন। রামপুরা-বাড্ডার রাজপথে, পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে, টিয়ারশেলের ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে যিনি কথা বলেছিলেন—তিনি ছিলেন হাদি। তাঁর ভাষা ছিল কঠিন, কখনো রুক্ষ, কিন্তু তাতে ছিল ভয়হীনতা। তিনি আপস করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। কেউ প্রশংসা করেছে, কেউ সমালোচনা করেছে—কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, এই তরুণ ভয় পান না। এই সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক প্রতীকী কণ্ঠস্বর।

নলছিটির শেকড়, ধর্মীয় শিক্ষার উত্তরাধিকার : শরীফ ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার হাড়িখালী গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। একটি আলেম পরিবার। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ—একজন শিক্ষক, সমাজসম্মানিত মানুষ। ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট হাদি বেড়ে উঠেছেন ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার আবহে। এই পরিবারের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কও কেবল সামাজিক নয়; আত্মীয়তার উষ্ণতায় জড়ানো। হাদির পিতা ছিলেন আমার শ্বশুর আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মো. আবদুল ওহাব খুলনার হুজুর (রহ.)–এর প্রিয় ছাত্র। একই মাদ্রাসার শিক্ষার উত্তরাধিকার যেন বহন করছিলেন হাদি—নৈতিক দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, আপসহীনতা।

শিক্ষা, মনন ও প্রতিবাদ : ঝালকাঠির এনএস কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন হাদি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কিন্তু তিনি কেবল ডিগ্রিধারী ছাত্র ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রতিবাদী। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন—সাইফুর’সসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস-এ শিক্ষকতা করছিলেন। নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে টিউশনি করেছেন, শ্রমের মর্যাদা জানতেন। তিনি কবিতা লিখতেন। সেই কবিতায় রাজনীতি ছিল, ক্ষোভ ছিল, আবার মানুষের প্রতি গভীর মমতাও ছিল।

ইনকিলাব মঞ্চ: একটি বিকল্প রাজনীতির স্বপ্ন : ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট—জুলাই অভ্যুত্থানের পর—হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। এর ঘোষিত লক্ষ্য—সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন।
এই মঞ্চ ছিল কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি ছিল পাঠাগার, সংস্কৃতি চর্চার জায়গা, বিকল্প চিন্তার কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র অনুদানে চলত সংগঠনটি। হাদি প্রকাশ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাইতেন। বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচারণা করতেন। এই রাজনীতি ছিল সরল, খোলা, নির্লোভ।

বিতর্কের ভেতরেও আপসহীন : ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙার ঘটনায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী বক্তব্য তাঁকে আরও বিতর্কিত করে তোলে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন—তার ভাষা অনেক সময় কঠিন হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো ভণ্ডামি করেননি। তিনি বিএনপি–জামায়াতের পুরোনো রাজনীতির সমালোচনাও করেছেন। আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিও ছিলেন প্রশ্নকারী। অর্থাৎ—তিনি কারও ‘কমফোর্ট জোনে’ ছিলেন না।

স্বতন্ত্র প্রার্থিতা ও হত্যাচেষ্টা : ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামেন হাদি। মানুষের কাছে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই এলো গুলি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারী হিসেবে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদকে শনাক্ত করেছে, যিনি ঘটনার পর ভারতে পালিয়েছেন। ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই পরিকল্পনার নেপথ্যে আর কারা?

মানুষ হিসেবে হাদি : হাদিকে যারা কাছ থেকে চিনতেন, তারা জানেন—তিনি কেবল বক্তা নন। উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল লিখেছেন, প্রয়োজনে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে খালি কার্পেটে ঘুমিয়েছেন, নিজের বালিশ দিয়ে দিয়েছেন অন্যের মাথার নিচে। একবার লিখেছিলেন—এক রুটি–কলা বিক্রেতা তাঁকে এক হাজার টাকার নোট দিতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,“এই মানুষগুলোর সাথে যেন কোনোদিন গাদ্দারি না করি খোদা।” এই বাক্যই বলে দেয়—এই মানুষের রাজনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে।

পরিবার, শূন্যতা ও শেষ বিদায় : বরিশালের রহমতপুরে তাঁর সংসার। কয়েক মাস আগে পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ছোট সন্তান—আজ তারা শোকের ভারে নুয়ে পড়েছেন। নলছিটির বাড়িতে কান্নার রোল। একটি টিনের ঘর—সেখানে জন্ম নেওয়া ছেলেটি আজ জাতির আলোচনার কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয়েছে। জানাজা, দোয়া, শোকবার্তা। কিন্তু শূন্যতা পূরণ হয় না।

হাদি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন এক ভয়ংকর প্রশ্ন— এই রাষ্ট্রে সত্য বলা কি এখন শাহাদাতের পথে হাঁটা? একটি গুলির শব্দ দুনিয়াবি কণ্ঠ থামিয়ে দিতে পারে, কিন্তু ঈমানি উচ্চারণ নয়। শহীদ শরীফ ওসমান হাদি—এখন আর কেবল একটি নাম নন; তিনি জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া এক জীবন্ত দলিল। গত শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় শহীদ হাদির মরদেহ বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৫ ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। রাতেই তাঁর মরদেহ রাখা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। আজ শনিবার দুপুর দুইটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। বিদ্রোহী কবির পাশে শায়িত হলেন আরেক বিদ্রোহী—যিনি কলম নয়, নিজের জীবন দিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।


ইসলামে শহীদ কেবল নিহত ব্যক্তি নন; শহীদ হলেন তিনি, যিনি জেনে-বুঝে সত্যের পক্ষে দাঁড়ান, পরিণতি জানার পরও পিছিয়ে যান না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” (তিরমিজি)। হাদি সেই জিহাদের কাতারেই দাঁড়িয়ে গেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী, আপসহীন দেশপ্রেমিক এই তরুণের শাহাদাতে শোকস্তব্ধ বাংলাদেশ। কেউ চোখের পানি ফেলেছে, কেউ রাজপথে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, কেউ সামাজিক মাধ্যমে শহীদের জন্য দোয়া করেছে—“হে আল্লাহ, তাকে শহীদের মর্যাদা দান করুন, তার রক্তকে আমাদের জন্য হিদায়াতের আলো বানিয়ে দিন।” আর অসংখ্য তরুণ শপথ করেছে—“আমরা সবাই হাদি হবো—সত্যের পথে অবিচল থাকবো।” হাদির শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদের ঢেউ। কারণ ইসলাম অন্যায়ের সামনে নীরবতাকে অনুমোদন দেয় না। কুরআন বলে—“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায়।” (সূরা নিসা: ১৩৫)। জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি প্রান্তে মানুষ নেমে আসে রাজপথে—কেউ স্লোগানে, কেউ দোয়ায়, কেউ অশ্রুসিক্ত চোখে। জানাজার আগে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে কফিন সামনে রেখে সহযোদ্ধারা শপথ নেন—“হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।” দাফনের সময় বিদ্রোহী কবির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল—এটি শুধু এক দাফন নয়; এটি এক প্রজন্মের আমানত গ্রহণ।
শহীদ হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক প্রশ্ন তুলেছেন—প্রকাশ্য হত্যার পরও বিচার কেন বিলম্বিত? ইসলাম স্পষ্ট—“একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমান।” (সূরা মায়িদা: ৩২) হাদির শাহাদাতে জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন—
“আমরা হাদিকে বিদায় দিতে আসিনি, আমরা তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে এসেছি।”

পরিশেষে : শাহাদাত থামে না শরীফ ওসমান হাদির ওপর ছোড়া গুলিটি কেবল একটি দেহ ভেদ করেনি—এটি একটি জাতির বিবেককে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইসলাম বলে, জুলুম স্থায়ী হয় না, আর শহীদের রক্ত কখনো নীরব থাকে না। হাদি নেই—কিন্তু তিনি অনুপস্থিত নন। তিনি আছেন প্রতিটি সাহসী দোয়ায়, প্রতিটি সত্য উচ্চারণে, প্রতিটি তরুণের ঈমানি দৃঢ়তায়। কিছু মানুষ মরেও বেঁচে থাকে—তারা থাকে সাক্ষ্য হয়ে, আলো হয়ে, হিদায়াত হয়ে। হাদি তেমনই একজন। বিদায় হাদি। তুমি কেবল একজন মানুষ নও—তুমি শাহাদাতের পথে হাঁটা এক আলোকবর্তিকা। তুমি আমাদের জন্য এক প্রশ্ন—আমরা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াবো, নাকি ভয়কে ইমানের ওপর প্রাধান্য দেবো?
একজন মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আল্লাহর পথে দাঁড়ানো সত্যকে নয়।

রোববার দিনের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি কমতে পারে

বিদায় জুলাই বিপ্লবের অগ্রসেনানী শরীফ ওসমান হাদি একটি নাম, একটি কণ্ঠস্বর, একটি রক্তাক্ত সময়

প্রকাশিত : ১০:০১:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫

জুবাইয়া বিন্তে কবির :   কিছু মৃত্যু আল্লাহ তায়ালার আদালতে সাধারণ মৃত্যু নয়—সেগুলো হয় সাক্ষ্য। সেগুলো হয় সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে রক্ত দিয়ে লেখা জবানবন্দি। কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—

“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদের তোমরা মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত, তাদের রবের কাছে রিজিকপ্রাপ্ত।” (সূরা আলে ইমরান: ১৬৯)। শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু তেমনই এক শাহাদাতের ডাক। এটি কোনো সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর প্রস্থান নয়; এটি সত্যের পথে অবিচল এক তরুণের রক্তাক্ত বিদায়, একটি জুলুমবিরোধী কণ্ঠস্বরের দুনিয়াবি নীরবতা, কিন্তু আখিরাতের আদালতে চিরজাগ্রত উপস্থিতি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু মৃত্যু একটি মানুষকে বিদায় দেয় না—সেগুলো একটি জাতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, আমাদের ঈমান, ন্যায়বোধ ও দায়িত্ববোধকে কাঠগড়ায় তোলে। হাদির শাহাদাত ঠিক তেমনই এক মুহূর্ত—যেখানে রাষ্ট্র নয়, সময় নয়; বিচারাধীন হয় আমাদের বিবেক।


মাত্র বত্রিশ বছরের এক তরুণ—যিনি ক্ষমতার দরবারে মাথা নত করেননি, কোনো নিরাপদ ছায়ায় আশ্রয় নেননি—দিনের আলোয়, জনসম্মুখে, গুলিবিদ্ধ হয়ে আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে তাঁর নিঃশ্বাস থামার মুহূর্তে হয়তো তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই জুলাই—রামপুরা, বাড্ডা, শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্য; আর সেই অগণিত মুখ, যারা ভয়কে জয় করে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল।

গুলির শব্দে থমকে যাওয়া একটি সময় : ১২ ডিসেম্বর, দুপুর সোয়া দুইটা। পুরানা পল্টনের বিজয়নগর এলাকা। ব্যস্ত নগরজীবনের মাঝখানে একটি মোটরসাইকেল থামে। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে আসে গুলি। মাথায় বিদ্ধ হয় বুলেট। রিকশায় থাকা তরুণটি লুটিয়ে পড়েন। রক্তে ভিজে যায় রাজধানীর রাজপথ। সেই গুলি কেবল হাদির শরীর ভেদ করেনি—তা আঘাত করেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিন। একজন সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী, যিনি কোনো বড় দলের নন, যিনি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বলয়ের বাইরের মানুষ—তাঁকে প্রকাশ্যে হত্যাচেষ্টা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি বার্তা। ভয় দেখানোর বার্তা। জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা—ক্ষমতার বয়ানের বাইরে দাঁড়ালে, এই পরিণতি অপেক্ষা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার, সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর। ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায়—বাংলাদেশ সময়—সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিভে যায় জুলাইয়ের এক প্রদীপ।

জুলাই অভ্যুত্থান: যেখানে হাদি হয়ে উঠলেন কণ্ঠস্বর :
২০২৪ সালের জুলাই—এই মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল একটি ক্যালেন্ডার নয়, এটি এক ধরনের জাগরণ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র–জনতার প্রতিরোধ, আর সেই প্রতিরোধের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু নির্ভীক মুখ। শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন তাঁদের একজন। রামপুরা-বাড্ডার রাজপথে, পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে, টিয়ারশেলের ধোঁয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে যিনি কথা বলেছিলেন—তিনি ছিলেন হাদি। তাঁর ভাষা ছিল কঠিন, কখনো রুক্ষ, কিন্তু তাতে ছিল ভয়হীনতা। তিনি আপস করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। কেউ প্রশংসা করেছে, কেউ সমালোচনা করেছে—কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, এই তরুণ ভয় পান না। এই সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক প্রতীকী কণ্ঠস্বর।

নলছিটির শেকড়, ধর্মীয় শিক্ষার উত্তরাধিকার : শরীফ ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার হাড়িখালী গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। একটি আলেম পরিবার। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ—একজন শিক্ষক, সমাজসম্মানিত মানুষ। ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট হাদি বেড়ে উঠেছেন ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার আবহে। এই পরিবারের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কও কেবল সামাজিক নয়; আত্মীয়তার উষ্ণতায় জড়ানো। হাদির পিতা ছিলেন আমার শ্বশুর আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মো. আবদুল ওহাব খুলনার হুজুর (রহ.)–এর প্রিয় ছাত্র। একই মাদ্রাসার শিক্ষার উত্তরাধিকার যেন বহন করছিলেন হাদি—নৈতিক দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, আপসহীনতা।

শিক্ষা, মনন ও প্রতিবাদ : ঝালকাঠির এনএস কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন হাদি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কিন্তু তিনি কেবল ডিগ্রিধারী ছাত্র ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রতিবাদী। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন—সাইফুর’সসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস-এ শিক্ষকতা করছিলেন। নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে টিউশনি করেছেন, শ্রমের মর্যাদা জানতেন। তিনি কবিতা লিখতেন। সেই কবিতায় রাজনীতি ছিল, ক্ষোভ ছিল, আবার মানুষের প্রতি গভীর মমতাও ছিল।

ইনকিলাব মঞ্চ: একটি বিকল্প রাজনীতির স্বপ্ন : ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট—জুলাই অভ্যুত্থানের পর—হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। এর ঘোষিত লক্ষ্য—সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন।
এই মঞ্চ ছিল কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি ছিল পাঠাগার, সংস্কৃতি চর্চার জায়গা, বিকল্প চিন্তার কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র অনুদানে চলত সংগঠনটি। হাদি প্রকাশ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাইতেন। বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচারণা করতেন। এই রাজনীতি ছিল সরল, খোলা, নির্লোভ।

বিতর্কের ভেতরেও আপসহীন : ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙার ঘটনায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী বক্তব্য তাঁকে আরও বিতর্কিত করে তোলে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন—তার ভাষা অনেক সময় কঠিন হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো ভণ্ডামি করেননি। তিনি বিএনপি–জামায়াতের পুরোনো রাজনীতির সমালোচনাও করেছেন। আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিও ছিলেন প্রশ্নকারী। অর্থাৎ—তিনি কারও ‘কমফোর্ট জোনে’ ছিলেন না।

স্বতন্ত্র প্রার্থিতা ও হত্যাচেষ্টা : ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামেন হাদি। মানুষের কাছে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই এলো গুলি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারী হিসেবে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদকে শনাক্ত করেছে, যিনি ঘটনার পর ভারতে পালিয়েছেন। ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই পরিকল্পনার নেপথ্যে আর কারা?

মানুষ হিসেবে হাদি : হাদিকে যারা কাছ থেকে চিনতেন, তারা জানেন—তিনি কেবল বক্তা নন। উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল লিখেছেন, প্রয়োজনে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে খালি কার্পেটে ঘুমিয়েছেন, নিজের বালিশ দিয়ে দিয়েছেন অন্যের মাথার নিচে। একবার লিখেছিলেন—এক রুটি–কলা বিক্রেতা তাঁকে এক হাজার টাকার নোট দিতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,“এই মানুষগুলোর সাথে যেন কোনোদিন গাদ্দারি না করি খোদা।” এই বাক্যই বলে দেয়—এই মানুষের রাজনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে।

পরিবার, শূন্যতা ও শেষ বিদায় : বরিশালের রহমতপুরে তাঁর সংসার। কয়েক মাস আগে পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ছোট সন্তান—আজ তারা শোকের ভারে নুয়ে পড়েছেন। নলছিটির বাড়িতে কান্নার রোল। একটি টিনের ঘর—সেখানে জন্ম নেওয়া ছেলেটি আজ জাতির আলোচনার কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয়েছে। জানাজা, দোয়া, শোকবার্তা। কিন্তু শূন্যতা পূরণ হয় না।

হাদি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন এক ভয়ংকর প্রশ্ন— এই রাষ্ট্রে সত্য বলা কি এখন শাহাদাতের পথে হাঁটা? একটি গুলির শব্দ দুনিয়াবি কণ্ঠ থামিয়ে দিতে পারে, কিন্তু ঈমানি উচ্চারণ নয়। শহীদ শরীফ ওসমান হাদি—এখন আর কেবল একটি নাম নন; তিনি জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া এক জীবন্ত দলিল। গত শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় শহীদ হাদির মরদেহ বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৫ ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। রাতেই তাঁর মরদেহ রাখা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। আজ শনিবার দুপুর দুইটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। বিদ্রোহী কবির পাশে শায়িত হলেন আরেক বিদ্রোহী—যিনি কলম নয়, নিজের জীবন দিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।


ইসলামে শহীদ কেবল নিহত ব্যক্তি নন; শহীদ হলেন তিনি, যিনি জেনে-বুঝে সত্যের পক্ষে দাঁড়ান, পরিণতি জানার পরও পিছিয়ে যান না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” (তিরমিজি)। হাদি সেই জিহাদের কাতারেই দাঁড়িয়ে গেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী, আপসহীন দেশপ্রেমিক এই তরুণের শাহাদাতে শোকস্তব্ধ বাংলাদেশ। কেউ চোখের পানি ফেলেছে, কেউ রাজপথে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, কেউ সামাজিক মাধ্যমে শহীদের জন্য দোয়া করেছে—“হে আল্লাহ, তাকে শহীদের মর্যাদা দান করুন, তার রক্তকে আমাদের জন্য হিদায়াতের আলো বানিয়ে দিন।” আর অসংখ্য তরুণ শপথ করেছে—“আমরা সবাই হাদি হবো—সত্যের পথে অবিচল থাকবো।” হাদির শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদের ঢেউ। কারণ ইসলাম অন্যায়ের সামনে নীরবতাকে অনুমোদন দেয় না। কুরআন বলে—“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায়।” (সূরা নিসা: ১৩৫)। জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি প্রান্তে মানুষ নেমে আসে রাজপথে—কেউ স্লোগানে, কেউ দোয়ায়, কেউ অশ্রুসিক্ত চোখে। জানাজার আগে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে কফিন সামনে রেখে সহযোদ্ধারা শপথ নেন—“হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।” দাফনের সময় বিদ্রোহী কবির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল—এটি শুধু এক দাফন নয়; এটি এক প্রজন্মের আমানত গ্রহণ।
শহীদ হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক প্রশ্ন তুলেছেন—প্রকাশ্য হত্যার পরও বিচার কেন বিলম্বিত? ইসলাম স্পষ্ট—“একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমান।” (সূরা মায়িদা: ৩২) হাদির শাহাদাতে জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন—
“আমরা হাদিকে বিদায় দিতে আসিনি, আমরা তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে এসেছি।”

পরিশেষে : শাহাদাত থামে না শরীফ ওসমান হাদির ওপর ছোড়া গুলিটি কেবল একটি দেহ ভেদ করেনি—এটি একটি জাতির বিবেককে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইসলাম বলে, জুলুম স্থায়ী হয় না, আর শহীদের রক্ত কখনো নীরব থাকে না। হাদি নেই—কিন্তু তিনি অনুপস্থিত নন। তিনি আছেন প্রতিটি সাহসী দোয়ায়, প্রতিটি সত্য উচ্চারণে, প্রতিটি তরুণের ঈমানি দৃঢ়তায়। কিছু মানুষ মরেও বেঁচে থাকে—তারা থাকে সাক্ষ্য হয়ে, আলো হয়ে, হিদায়াত হয়ে। হাদি তেমনই একজন। বিদায় হাদি। তুমি কেবল একজন মানুষ নও—তুমি শাহাদাতের পথে হাঁটা এক আলোকবর্তিকা। তুমি আমাদের জন্য এক প্রশ্ন—আমরা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াবো, নাকি ভয়কে ইমানের ওপর প্রাধান্য দেবো?
একজন মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আল্লাহর পথে দাঁড়ানো সত্যকে নয়।