ঢাকা ০৯:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ঋণের বোঝা ও দস্যু আতঙ্কে জেলেদের দুশ্চিন্তা

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ০৪:২৬:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ৫ বার দেখা হয়েছে

প্রতি বছরের মতো এবারও সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হয়েছে শুঁটকি তৈরির মৌসুম। জীবিকার তাগিদে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন উপকূলের হাজারো জেলে। কাঁধে ভারী ঋণের বোঝা, সামনে পাঁচ মাসের অনিশ্চিত জীবন। কেউ স্বর্ণ বন্ধক রেখে, কেউ আবার চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে রওনা হচ্ছেন সাগরের পথে।

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাত থেকে শুরু হচ্ছে তাদের দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুমের যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি ও মহাজনের দেনা মাথায় নিয়েই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় সমুদ্রে নামছেন তারা।

আগামী পাঁচ মাস এই জেলেরা দুবলার চরে অবস্থান করবেন। সেখানে তারা বিভিন্ন জাতের মাছ শুঁটকি করবেন। দুবলার চর বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা, পূণ্যস্নান এবং হরিণের জন্য পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মাঝখানে অবস্থিত এই বিচ্ছিন্ন চরের আয়তন প্রায় ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকেল্লা, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া ও মেহের আলির চর মিলে দুবলার চর গঠিত।

দুবলার চরে গড়ে ওঠে অস্থায়ী জেলে গ্রাম। মাছ ধরা ও শুঁটকি শুকানোর কাজ চলে পাশাপাশি। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ শিকার শেষে বহু জেলে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ মাসের জন্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে এসে এখানে সাময়িক বসতি গড়ে তোলেন। মেহের আলির খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর এলাকায় জেলেপল্লী স্থাপন হয়। এই কয়েক মাস তারা মাছ শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখানকার শুঁটকি পরে পাইকারি বাজারে মজুদ ও বিক্রি করা হয়।

সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করেন। এখান থেকে সরকার নিয়মিত রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট), ডিএফসি (ডেইলি ফুয়েল কনজাম্পশন) ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি পান। এছাড়া শুঁটকি মাছ আহরণ শেষে মাছভেদে নির্ধারিত রাজস্বও দিতে হয়।

শুধু সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া এবং নানা প্রতিকূলতার কারণে জেলে পরিবারগুলোর ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। বরং দিন দিন তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। অনেকেই ক্ষতির মুখে পুঁজি, জাল ও নৌকা হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। জেলেরা জানাচ্ছেন, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে হয়। কেউ এনজিও, ব্যাংক বা সমিতি থেকে ঋণ নেন। ঋণ আর সুদের বোঝা মাথায় নিয়েই তারা শুরু করছেন পাঁচ মাসের অনিশ্চিত জীবন।

ডুমুরিয়া এলাকার বহদ্দার রবিন বিশ্বাস বলেন, প্রতি বছর আমরা ঋণ করে সমুদ্রে যাই। এবছরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে যাচ্ছি। সরকারিভাবে তেমন কোনো সহায়তা পাই না। আগে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায় ছিল, কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন আবার নাকি বাড়ছে।

কড়াইদিয়া এলাকার জেলে দ্বীপক মল্লিক বলেন, বনবিভাগের পাস নিয়েই আমরা রওনা হই দুবলার চরে। ধার-দেনা করেই সাগরে যেতে হয়। অনেকে এবার সুদে টাকা না নিয়ে স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করছেন। আগে দস্যুদের উৎপাত বন্ধ ছিল, কিন্তু এবার আবার দেখা যাচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানী ও ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই আমরা হাজার হাজার জেলে সমুদ্রে নামছি।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখার সভাপতি বিদ্যুৎ মণ্ডল বলেন, পাস-পরমিট হাতে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সব জেলেই দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তারা এখান থেকে সব প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে যাবেন।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, বনবিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে জেলেদের সরাসরি দুবলার চরে যেতে হবে। সেখানে ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরির জন্য সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, গত শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চর থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবারও সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায়ের আশা করছি।

জনপ্রিয় সংবাদ

পরীক্ষায় ডিভাইস ব্যবহার: পটুয়াখালীতে পরীক্ষার্থীসহ তিনজনের কারাদণ্ড

ঋণের বোঝা ও দস্যু আতঙ্কে জেলেদের দুশ্চিন্তা

প্রকাশিত : ০৪:২৬:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

প্রতি বছরের মতো এবারও সুন্দরবনের দুবলার চরে শুরু হয়েছে শুঁটকি তৈরির মৌসুম। জীবিকার তাগিদে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন উপকূলের হাজারো জেলে। কাঁধে ভারী ঋণের বোঝা, সামনে পাঁচ মাসের অনিশ্চিত জীবন। কেউ স্বর্ণ বন্ধক রেখে, কেউ আবার চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে রওনা হচ্ছেন সাগরের পথে।

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাত থেকে শুরু হচ্ছে তাদের দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুমের যাত্রা। জীবনের ঝুঁকি ও মহাজনের দেনা মাথায় নিয়েই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় সমুদ্রে নামছেন তারা।

আগামী পাঁচ মাস এই জেলেরা দুবলার চরে অবস্থান করবেন। সেখানে তারা বিভিন্ন জাতের মাছ শুঁটকি করবেন। দুবলার চর বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা, পূণ্যস্নান এবং হরিণের জন্য পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মাঝখানে অবস্থিত এই বিচ্ছিন্ন চরের আয়তন প্রায় ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকেল্লা, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া ও মেহের আলির চর মিলে দুবলার চর গঠিত।

দুবলার চরে গড়ে ওঠে অস্থায়ী জেলে গ্রাম। মাছ ধরা ও শুঁটকি শুকানোর কাজ চলে পাশাপাশি। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ শিকার শেষে বহু জেলে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ মাসের জন্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে এসে এখানে সাময়িক বসতি গড়ে তোলেন। মেহের আলির খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর এলাকায় জেলেপল্লী স্থাপন হয়। এই কয়েক মাস তারা মাছ শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখানকার শুঁটকি পরে পাইকারি বাজারে মজুদ ও বিক্রি করা হয়।

সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করেন। এখান থেকে সরকার নিয়মিত রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট), ডিএফসি (ডেইলি ফুয়েল কনজাম্পশন) ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি পান। এছাড়া শুঁটকি মাছ আহরণ শেষে মাছভেদে নির্ধারিত রাজস্বও দিতে হয়।

শুধু সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া এবং নানা প্রতিকূলতার কারণে জেলে পরিবারগুলোর ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। বরং দিন দিন তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। অনেকেই ক্ষতির মুখে পুঁজি, জাল ও নৌকা হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। জেলেরা জানাচ্ছেন, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে হয়। কেউ এনজিও, ব্যাংক বা সমিতি থেকে ঋণ নেন। ঋণ আর সুদের বোঝা মাথায় নিয়েই তারা শুরু করছেন পাঁচ মাসের অনিশ্চিত জীবন।

ডুমুরিয়া এলাকার বহদ্দার রবিন বিশ্বাস বলেন, প্রতি বছর আমরা ঋণ করে সমুদ্রে যাই। এবছরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে যাচ্ছি। সরকারিভাবে তেমন কোনো সহায়তা পাই না। আগে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায় ছিল, কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন আবার নাকি বাড়ছে।

কড়াইদিয়া এলাকার জেলে দ্বীপক মল্লিক বলেন, বনবিভাগের পাস নিয়েই আমরা রওনা হই দুবলার চরে। ধার-দেনা করেই সাগরে যেতে হয়। অনেকে এবার সুদে টাকা না নিয়ে স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করছেন। আগে দস্যুদের উৎপাত বন্ধ ছিল, কিন্তু এবার আবার দেখা যাচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানী ও ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই আমরা হাজার হাজার জেলে সমুদ্রে নামছি।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মোংলা শাখার সভাপতি বিদ্যুৎ মণ্ডল বলেন, পাস-পরমিট হাতে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সব জেলেই দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তারা এখান থেকে সব প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে যাবেন।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, বনবিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে জেলেদের সরাসরি দুবলার চরে যেতে হবে। সেখানে ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরির জন্য সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, গত শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চর থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবারও সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায়ের আশা করছি।