ঢাকা ০৯:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জুলাইয়ের কণ্ঠস্বর হাদি একটি নাম, একটি অবস্থান ও গণতন্ত্র—গুলির নিশানায় আমরা সবাই

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ০৭:৪৩:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ১ বার দেখা হয়েছে

জুবাইয়া বিন্তে কবির:  বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু গুলি থাকে, যেগুলো কেবল কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় না—সেগুলো আঘাত করে সময়কে, সম্ভাবনাকে, এবং একটি জাতির গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসকে। রাজধানীর বিজয়নগরের ব্যস্ত সড়কে খুব কাছ থেকে ছোড়া সেই গুলি শরীফ ওসমান হাদির মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে—কিন্তু তার অভিঘাত গিয়ে লেগেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বুকে। শুক্রবার দুপুর। নির্বাচন তফশিল ঘোষণার পরদিন। প্রকাশ্য রাস্তায়, দিনের আলোয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী—যিনি কোনো প্রতিষ্ঠিত দলের প্রার্থী নন, যিনি রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো বলয়েও নেই—তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়; এটি একটি বার্তা। ভয় দেখানোর বার্তা। ভিন্নমতের রাজনীতি করলে, ক্ষমতার বয়ানের বাইরে দাঁড়ালে কী পরিণতি হতে পারে—তার এক নগ্ন প্রদর্শনী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতির ময়দান :
শরীফ ওসমান হাদি নামটি গত এক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত, বিতর্কিত এবং একই সঙ্গে অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় ছাত্র–জনতার প্রতিরোধে যাঁরা সম্মুখসারিতে ছিলেন, হাদি তাঁদের অন্যতম সমন্বয়ক। তুখোড় বক্তব্য, আপসহীন ভাষা এবং স্পষ্ট অবস্থানের কারণে খুব অল্প সময়েই তিনি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কাড়েন। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—এই সময়টা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি সময়কাল নয়; এটি এক ধরনের রাজনৈতিক জাগরণের অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন ওসমান হাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে, প্রশংসা ও সমালোচনা—দুটোই আসে সমানতালে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, তিনি ভয় পান না।

পরিচয়ের শেকড় : ঝালকাঠির নলছিটি : ওসমান হাদির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার হাড়িখালী গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ—একজন আলেম, শিক্ষক ও সমাজসম্মানিত ব্যক্তি। ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট হাদি বেড়ে উঠেছেন ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার আবহে। এই পরিবারের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত সম্পর্কও কেবল সামাজিক নয়, আত্মীয়তার উষ্ণতায় জড়ানো। হাদির বাবা মাওলানা হাদি হুজুর ছিলেন আমার শ্বশুর আব্বা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আবদুল ওহাব খুলনার হুজুর (রহ.)–এর প্রিয় ছাত্র। নলছিটি ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যখন আমার শ্বশুর আব্বা শিক্ষকতা করতেন, তখন একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতেন হাদির বাবা। সেই শিক্ষার উত্তরাধিকার, সেই আদর্শের উত্তরাধিকারই যেন আজ বহন করছেন ওসমান হাদি।

শিক্ষা ও মননের যাত্রা : শৈশবে পিতার মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর হাদি ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এরপর ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি কেবল একজন শিক্ষার্থী ছিলেন না; তিনি ছিলেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক প্রতিবাদী কণ্ঠ।

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থাকা হাদি পরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। সাইফুর’সসহ একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন—যে কবিতায় রাজনীতি আছে, ক্ষোভ আছে, আবার মানুষের প্রতি গভীর মমতাও আছে।

প্রতিবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতা : ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’–খ্যাত নির্বাচন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি রাজনৈতিক পর্বে হাদিকে দেখা গেছে রাজপথে। তাঁর রাজনীতি কখনোই সুবিধাবাদী ছিল না। তিনি কোনো দলীয় পদ-পদবির আশায় রাজনীতি করেননি। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইনকিলাব মঞ্চ। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র চাঁদায় পরিচালিত এই সংগঠনটি শুধু রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়; এটি পাঠাগার, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র এবং বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা তৈরি করেছে। ইনকিলাব মঞ্চের ঘোষিত নীতি—আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন।

বিতর্ক, সমালোচনা এবং অবস্থান : শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ইনকিলাব মঞ্চের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী ও দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে হাদির কঠোর ভাষা তাঁকে আরও বিতর্কিত করে তোলে।
তিনি নিজেই বলেছেন—তার ভাষা অনেক সময় গালিগালাজপূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সেটিকে তিনি দেখেছেন ‘মুক্তির মহাকাব্য’ হিসেবে। কেউ কষ্ট পেলে তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন। সমর্থকদের চোখে, এই ভাষা ছিল জুলাইয়ের অবিচল অবস্থানের প্রতিফলন।

একই সঙ্গে তিনি পুরোনো ধারার রাজনীতির অভিযোগ তুলে বিএনপি–জামায়াতেরও সমালোচনা করেছেন। আবার কাঠামোগত দুর্বলতা ও দৃশ্যমান পরিবর্তনের অভাবের কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিও ছিলেন সমালোচনামুখর। অর্থাৎ—তিনি কারও ‘কমফোর্ট জোনে’ ছিলেন না।

স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ঘোষণা : কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়ে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন ওসমান হাদি। কয়েক মাস ধরে তিনি মাঠে ছিলেন, মানুষের কাছে যাচ্ছিলেন। সেই প্রচারণার মাঝেই এলো হত্যাচেষ্টা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু অভিযোগ করেছেন—ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা নাকি আগেই হাদির প্রচারণা টিমে ঢুকে পড়েছিল। অর্থাৎ এটি ছিল সুপরিকল্পিত। সরকার ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, দ্রুত গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়—রাষ্ট্র যদি যথাসময়ে শক্তভাবে দাঁড়াত, তবে দিনের আলোয় একজন রাজনৈতিক কর্মীকে এভাবে গুলি খেতে হতো কি?

মানুষ হিসেবে হাদি : হাদিকে যারা কাছ থেকে চেনে, তারা জানে—তিনি কেবল একজন বক্তা বা আন্দোলনকারী নন। উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন, প্রয়োজনে হাদি সহকর্মীদের সঙ্গে খালি কার্পেটে ঘুমিয়েছেন, নিজের বালিশ দিয়ে দিয়েছেন অন্যের মাথার নিচে, কর্মীর কাপড় নিজে ধুয়ে দিয়েছেন। হাদি নিজে একবার লিখেছিলেন—ফজরের ক্যাম্পেইন শেষে বাংলামোটর মোড়ে এক রুটি–কলা বিক্রেতা চাচা তাঁকে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে দেন। নিতে না চাইলেও তিনি জোর করেন। হাদি লিখেছিলেন,“রক্ত পানি করা পয়সায় মানুষ আমাদেরকে ভালোবাসে শুধু দেশটাকে একটু দাঁড় করানোর জন্য। আর আমরা তা কেজি দরে বেচে দেই। এই মানুষগুলোর সাথে যেন কোনোদিন গাদ্দারি না করি খোদা।” এই লেখাই বলে দেয়—এই মানুষটির রাজনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে।

পরিবার ও বর্তমান জীবন : বরিশালের রহমতপুরে বিয়ে করেছেন ওসমান হাদি। কয়েক মাস আগে তিনি পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার রামপুরায় বসবাস করেন। তাঁর বৃদ্ধা মাও এখন ঢাকাতেই আছেন। হাসপাতালে তাঁর বোনের বুকফাটা আর্তনাদ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন—এই আঘাত শুধু একজন কর্মীর নয়, একটি পরিবারের হৃদয় ছিন্ন করেছে।

পরিশেষে, শরীফ ওসমান হাদির ওপর এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই। কারণ এই গুলি কেবল একজন মানুষের শরীরে নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বুকে ছোড়া হয়েছে। যদি এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয়, তবে ভিন্নমত পোষণ করাই একদিন অপরাধ হয়ে দাঁড়াবে। আজ হাদি হাসপাতালের শয্যায়। কিন্তু তাঁর সাহস, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর অবস্থান এখনো দাঁড়িয়ে আছে রাজপথের মতোই দৃঢ় হয়ে। এতো মানুষের দোয়া, এতো মানুষের ভালোবাসা—ইনশাল্লাহ তিনি ফিরবেন। ফিরবেন শুধু একজন মানুষ হিসেবে নয়—ফিরবেন আহত গণতন্ত্রের জন্য এক জীবন্ত প্রত্যয় হয়ে।

‘মানি লন্ডারিং বেঞ্চ বুক’ উদ্বোধন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে

জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জুলাইয়ের কণ্ঠস্বর হাদি একটি নাম, একটি অবস্থান ও গণতন্ত্র—গুলির নিশানায় আমরা সবাই

প্রকাশিত : ০৭:৪৩:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫

জুবাইয়া বিন্তে কবির:  বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু গুলি থাকে, যেগুলো কেবল কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় না—সেগুলো আঘাত করে সময়কে, সম্ভাবনাকে, এবং একটি জাতির গণতান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসকে। রাজধানীর বিজয়নগরের ব্যস্ত সড়কে খুব কাছ থেকে ছোড়া সেই গুলি শরীফ ওসমান হাদির মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে—কিন্তু তার অভিঘাত গিয়ে লেগেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বুকে। শুক্রবার দুপুর। নির্বাচন তফশিল ঘোষণার পরদিন। প্রকাশ্য রাস্তায়, দিনের আলোয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী—যিনি কোনো প্রতিষ্ঠিত দলের প্রার্থী নন, যিনি রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো বলয়েও নেই—তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়; এটি একটি বার্তা। ভয় দেখানোর বার্তা। ভিন্নমতের রাজনীতি করলে, ক্ষমতার বয়ানের বাইরে দাঁড়ালে কী পরিণতি হতে পারে—তার এক নগ্ন প্রদর্শনী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতির ময়দান :
শরীফ ওসমান হাদি নামটি গত এক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত, বিতর্কিত এবং একই সঙ্গে অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় ছাত্র–জনতার প্রতিরোধে যাঁরা সম্মুখসারিতে ছিলেন, হাদি তাঁদের অন্যতম সমন্বয়ক। তুখোড় বক্তব্য, আপসহীন ভাষা এবং স্পষ্ট অবস্থানের কারণে খুব অল্প সময়েই তিনি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কাড়েন। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—এই সময়টা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি সময়কাল নয়; এটি এক ধরনের রাজনৈতিক জাগরণের অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন ওসমান হাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে, প্রশংসা ও সমালোচনা—দুটোই আসে সমানতালে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারেনি, তিনি ভয় পান না।

পরিচয়ের শেকড় : ঝালকাঠির নলছিটি : ওসমান হাদির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার হাড়িখালী গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ—একজন আলেম, শিক্ষক ও সমাজসম্মানিত ব্যক্তি। ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট হাদি বেড়ে উঠেছেন ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার আবহে। এই পরিবারের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত সম্পর্কও কেবল সামাজিক নয়, আত্মীয়তার উষ্ণতায় জড়ানো। হাদির বাবা মাওলানা হাদি হুজুর ছিলেন আমার শ্বশুর আব্বা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোঃ আবদুল ওহাব খুলনার হুজুর (রহ.)–এর প্রিয় ছাত্র। নলছিটি ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যখন আমার শ্বশুর আব্বা শিক্ষকতা করতেন, তখন একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতেন হাদির বাবা। সেই শিক্ষার উত্তরাধিকার, সেই আদর্শের উত্তরাধিকারই যেন আজ বহন করছেন ওসমান হাদি।

শিক্ষা ও মননের যাত্রা : শৈশবে পিতার মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর হাদি ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এরপর ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি কেবল একজন শিক্ষার্থী ছিলেন না; তিনি ছিলেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক প্রতিবাদী কণ্ঠ।

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থাকা হাদি পরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। সাইফুর’সসহ একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন—যে কবিতায় রাজনীতি আছে, ক্ষোভ আছে, আবার মানুষের প্রতি গভীর মমতাও আছে।

প্রতিবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতা : ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’–খ্যাত নির্বাচন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি রাজনৈতিক পর্বে হাদিকে দেখা গেছে রাজপথে। তাঁর রাজনীতি কখনোই সুবিধাবাদী ছিল না। তিনি কোনো দলীয় পদ-পদবির আশায় রাজনীতি করেননি। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইনকিলাব মঞ্চ। সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র চাঁদায় পরিচালিত এই সংগঠনটি শুধু রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়; এটি পাঠাগার, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র এবং বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা তৈরি করেছে। ইনকিলাব মঞ্চের ঘোষিত নীতি—আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন।

বিতর্ক, সমালোচনা এবং অবস্থান : শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ইনকিলাব মঞ্চের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী ও দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে হাদির কঠোর ভাষা তাঁকে আরও বিতর্কিত করে তোলে।
তিনি নিজেই বলেছেন—তার ভাষা অনেক সময় গালিগালাজপূর্ণ হয়েছে, কিন্তু সেটিকে তিনি দেখেছেন ‘মুক্তির মহাকাব্য’ হিসেবে। কেউ কষ্ট পেলে তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন। সমর্থকদের চোখে, এই ভাষা ছিল জুলাইয়ের অবিচল অবস্থানের প্রতিফলন।

একই সঙ্গে তিনি পুরোনো ধারার রাজনীতির অভিযোগ তুলে বিএনপি–জামায়াতেরও সমালোচনা করেছেন। আবার কাঠামোগত দুর্বলতা ও দৃশ্যমান পরিবর্তনের অভাবের কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিও ছিলেন সমালোচনামুখর। অর্থাৎ—তিনি কারও ‘কমফোর্ট জোনে’ ছিলেন না।

স্বতন্ত্র প্রার্থিতার ঘোষণা : কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়ে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন ওসমান হাদি। কয়েক মাস ধরে তিনি মাঠে ছিলেন, মানুষের কাছে যাচ্ছিলেন। সেই প্রচারণার মাঝেই এলো হত্যাচেষ্টা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু অভিযোগ করেছেন—ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা নাকি আগেই হাদির প্রচারণা টিমে ঢুকে পড়েছিল। অর্থাৎ এটি ছিল সুপরিকল্পিত। সরকার ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, দ্রুত গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়—রাষ্ট্র যদি যথাসময়ে শক্তভাবে দাঁড়াত, তবে দিনের আলোয় একজন রাজনৈতিক কর্মীকে এভাবে গুলি খেতে হতো কি?

মানুষ হিসেবে হাদি : হাদিকে যারা কাছ থেকে চেনে, তারা জানে—তিনি কেবল একজন বক্তা বা আন্দোলনকারী নন। উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন, প্রয়োজনে হাদি সহকর্মীদের সঙ্গে খালি কার্পেটে ঘুমিয়েছেন, নিজের বালিশ দিয়ে দিয়েছেন অন্যের মাথার নিচে, কর্মীর কাপড় নিজে ধুয়ে দিয়েছেন। হাদি নিজে একবার লিখেছিলেন—ফজরের ক্যাম্পেইন শেষে বাংলামোটর মোড়ে এক রুটি–কলা বিক্রেতা চাচা তাঁকে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে দেন। নিতে না চাইলেও তিনি জোর করেন। হাদি লিখেছিলেন,“রক্ত পানি করা পয়সায় মানুষ আমাদেরকে ভালোবাসে শুধু দেশটাকে একটু দাঁড় করানোর জন্য। আর আমরা তা কেজি দরে বেচে দেই। এই মানুষগুলোর সাথে যেন কোনোদিন গাদ্দারি না করি খোদা।” এই লেখাই বলে দেয়—এই মানুষটির রাজনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে।

পরিবার ও বর্তমান জীবন : বরিশালের রহমতপুরে বিয়ে করেছেন ওসমান হাদি। কয়েক মাস আগে তিনি পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার রামপুরায় বসবাস করেন। তাঁর বৃদ্ধা মাও এখন ঢাকাতেই আছেন। হাসপাতালে তাঁর বোনের বুকফাটা আর্তনাদ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন—এই আঘাত শুধু একজন কর্মীর নয়, একটি পরিবারের হৃদয় ছিন্ন করেছে।

পরিশেষে, শরীফ ওসমান হাদির ওপর এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই। কারণ এই গুলি কেবল একজন মানুষের শরীরে নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বুকে ছোড়া হয়েছে। যদি এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয়, তবে ভিন্নমত পোষণ করাই একদিন অপরাধ হয়ে দাঁড়াবে। আজ হাদি হাসপাতালের শয্যায়। কিন্তু তাঁর সাহস, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর অবস্থান এখনো দাঁড়িয়ে আছে রাজপথের মতোই দৃঢ় হয়ে। এতো মানুষের দোয়া, এতো মানুষের ভালোবাসা—ইনশাল্লাহ তিনি ফিরবেন। ফিরবেন শুধু একজন মানুষ হিসেবে নয়—ফিরবেন আহত গণতন্ত্রের জন্য এক জীবন্ত প্রত্যয় হয়ে।