মোঃ আফজাল হোসেন
যে সড়ক ধরে প্রতিদিন স্কুলগামী শিশুরা হাঁটে, অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে পৌঁছাতে চায়, কর্মজীবী মানুষ সময়মতো কাজে ছুটে—সে সড়ক যদি পরিণত হয় কর্দমাক্ত এক মৃত্যুফাঁদে, তবে তার চেয়ে বড় আর কী অবহেলা হতে পারে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে?
পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার বুক চিরে পাগলা থেকে বগা মহাসড়কে যুক্ত হওয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কের নাম— “দুমকী বিসমিল্লাহ সড়ক”। নামের মাঝে যে আশীর্বাদ, যে শুভ সূচনা, বাস্তবে সেই আশীর্বাদ যেন হারিয়ে গেছে দুর্ভোগের এক দীর্ঘস্থায়ী করুণ অধ্যায়ে। একটি সড়ক শুধু মাটির তৈরি পথ নয়, সেটি একটি জনপদের শ্বাস-প্রশ্বাস, স্বপ্ন-বাস্তবতার সংযোগরেখা। অথচ সেই সড়কই যদি হয় করুণ দুর্দশার প্রতিচ্ছবি, তবে জীবন হয়ে দাঁড়ায় প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের অন্য নাম।
অঞ্চল গঠনের ইতিহাস: একটি স্বপ্নের সূচনা:-
এই সড়ককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে একটি মানুষের পাড়া, একটি স্বপ্নময় বসতভিটে। ২০০০ সালে এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, মরহুম হাজী আবুল হোসেন মল্লিক সাহেব প্রথম এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর আগ্রহ ও দূরদৃষ্টিতে ধীরে ধীরে এখানে গড়ে ওঠে শত শত ঘরবাড়ি, সৃষ্টি হয় একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দুই দশক পেরিয়ে গেলেও এই জনপদের প্রবেশপথ এখনো থেকে গেছে উন্নয়ন-বঞ্চিত, ব্যথা-বিজড়িত।
করুণ বাস্তবতা: চলাচলের নামে চরম দুর্ভোগ:-
এই সড়কের সবচেয়ে বড় সমস্যা পানিনিষ্কাশনের অভাব। সামান্য বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে থাকে দীর্ঘ সময়। রাস্তার মধ্যখানে সৃষ্টি হয় গর্ত, ভেঙে যায় কংক্রিটের অবশিষ্ট অংশ। বৃষ্টির দিনে তো বটেই, শুকনো মৌসুমেও এই রাস্তায় হাঁটলে কাদা জড়ায় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত।
রিকশা বা বাইসাইকেল তো দুরস্ত, পায়ে হেঁটেও চলা যায় না নিরাপদে। অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থী, গর্ভবতী নারী, প্রবীণ কিংবা অসুস্থ রোগীরা—প্রতিদিন যেন জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পাড়ি দেন এই মৃত্যুকূপ। এমনও বহুবার ঘটেছে, অ্যাম্বুলেন্স না ঢুকতে পারায় হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অসুস্থ রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে গেছে, কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।
জনতার নির্ভরতা: সীমিত উদ্যোগ, সীমাহীন প্রত্যাশা:- যেখানে রাষ্ট্রের হাত পৌঁছায়নি, সেখানেই মানুষের প্রত্যয় এগিয়ে এসেছে। এলাকার তরুণরা মাটি ফেলেছেন, নিজের খরচে ইট-বালি এনে রাস্তাটিকে সাময়িকভাবে চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা তো শুধুই একটি অস্থায়ী প্রতিরোধ। বৃষ্টির পানি সেই ইট মুছে দেয়, মাটি গিলে নেয় প্রচেষ্টা। তবুও মানুষ থেমে নেই, কারণ বাঁচতে হলে পথ চাই। এই লড়াই যেন দুমকীবাসীর প্রতিদিনের মাটি-কাদার প্রার্থনা।
শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণার গল্প:- একটি রাস্তা যেখানে শিক্ষা থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, তা কেবল একটি সড়ক নয়—তা হয়ে ওঠে অন্ধকারের এক প্রতীক। বিসমিল্লাহ সড়কের দুর্দশায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিদিন কোমলমতি শিশুরা স্কুলে যেতে গিয়ে কাদায় পড়ে যায়, জামা-কাপড় ভিজে যায়, মনোবল হারিয়ে যায়। অনেক সময় তারা স্কুলে পৌঁছাতে পারে না। এক পর্যায়ে এসব শিশুদের চোখে ‘স্কুল’ হয়ে ওঠে কষ্টের অন্য নাম। কত প্রতিভা, কত স্বপ্ন যে এই কর্দমাক্ত সড়কে থেমে যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই।
কর্মজীবীদের দুর্ভোগ, অর্থনীতির স্থবিরতা:-
এই সড়ক ব্যবহার করেন অসংখ্য শ্রমিক, দোকানি, শিক্ষক, দিনমজুর। তারা প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় ভোগেন চরম মানসিক ও শারীরিক কষ্টে। কাপড়চোপড় কাদায় ভেজে, জুতা আটকে যায় রাস্তার গর্তে, অনেকে পা পিছলে পড়ে আহত হন। আর এদিকে এলাকায় ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যও থমকে আছে—কেউ গাড়ি নিয়ে আসতে চায় না, কেনাকাটার সুযোগ কম। জমির দাম কমে গেছে, বিনিয়োগ নেই, স্বপ্নগুলো আটকে আছে কাদার গন্ধে।
সরকারের করণীয়: প্রতিশ্রুতি নয়, পদক্ষেপ চাই:-
সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (LGED), ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের উচিত এই সড়কটির প্রতি অবিলম্বে দৃষ্টি দেওয়া। এটি কেবল একটি রাস্তা নয়—এটি একটি জনপদের হৃদস্পন্দন। এই সড়ককে সরকারি আইডিভুক্ত করে দ্রুত বাজেট বরাদ্দ দিয়ে পাকা করার উদ্যোগ নিতে হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে পানি জমে না থাকে। পাশাপাশি, নিরাপত্তার স্বার্থে স্ট্রিট লাইট বসানোর ব্যবস্থাও জরুরি।
কেন জরুরি এই উন্নয়ন?
এলাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত। রোগী পরিবহনে নিরাপদ ও দ্রুত ব্যবস্থা। কর্মজীবীদের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল। স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হওয়া
।জমির দাম বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা।
এই সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে একটি আধুনিক জনপদ, যদি রাষ্ট্র চায়।
অন্তিম অনুরোধ:-“বিসমিল্লাহ” শব্দটির অর্থ “আল্লাহর নামে শুরু”। এই রাস্তার নামেই যেন লুকিয়ে আছে আশা ও আশীর্বাদের ইঙ্গিত। এখন সময় এসেছে সেই আশীর্বাদকে বাস্তবের ছোঁয়া দেওয়ার। এই সড়ক যেন হয়ে না থাকে কেবল দুঃখের ইতিহাস, বরং হয়ে উঠুক উন্নয়নের দীপ্ত গল্প। সরকারের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন—এই সড়কটিকে দিন আপনার দৃষ্টি, আপনার পরিকল্পনা, আপনার করুণা। তা না হলে হাজারো প্রাণ আর প্রতিদিনের কান্না এই কাদা-পথেই হারিয়ে যাবে সময়ের অতলে।